বহুরূপে সম্মুখে তোমার
ছাড়ি কোথা, খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
একথাটা আমি বা আমরা ছোটবেলার থেকেই শুনে আসছি। তিনজন মহিলার জীবন ও কাজের দিকে তাকিয়ে আমি এই সত্যটা আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারি। এরা হলেন সিস্টার নিবেদিতা, মাদার টেরিজা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনা সঙ্কট আজ সভ্যতাকে যে জায়গায় এনে ফেলেছে তাতে আমাদের এই তিনজনের কাজের দিকে তাকানো খুব জরুরি।
১৮৯৯ এ কলকাতার প্লেগে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশে সিস্টার নিবেদিতা যে ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, নিজের জীবন বিপন্ন করে সেবা করেছিলেন মানুষের তা কারোর অজানা নয়। এসব কথা আমরা জেনেছি বইয়ের পাতায় বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে। নিবেদিতাকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু পরের দুজনের কাজের সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। কলকাতায় মাদার টেরিজার কাজের শেষের দিকে আমার সাংবাদিকতার শুরু। ৮৩-৮৪ থেকে আমি মাদারের বহু সেবামূলক কর্মযজ্ঞ ধারাবাহিকভাবে ক্যামেরাবন্দি করেছি। একটা কথা না বললেই নয়, সেই সময় আনন্দবাজারের নিউজ এডিটর বিজয় চক্রবর্তী আমায় বলতেন, এত মাদারের ছবি তোলো কেন? জানো না আমরা মাদারের ছবি ছাপি না, এডিটর অভীক সরকারের মাদার না-পসন্দ। তবুও আমি মাদারের ছবি তুলতাম কারণ আমার মনে হত, এ ছবিগুলির একটা আর্কাইভাল ভ্যালু আছে। এ ছবি ইতিহাসে থেকে যাবে। আমি দেখেছি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, মাদার কীভাবে কার্ফু কবলিত এলাকার ভিতরে গিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করতেন।
উল্লেখ্য ঠিক সেই সময়ে শহরের রাস্তাতে আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখেছিলাম। আমি দেখেছি উদীয়মান এই কংগ্রেস নেত্রী তখন কোন জাতপাতের তোয়াক্কা না করে কীভাবে কলকাতার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন! দীর্ঘদিন ধরে আমি আমাদের প্রিয় দিদি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি তুলে চলেছি, এ জন্য আমি গর্বিত। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় বারবার দেখেছি নিজের ব্যস্ততা, অসুস্থতা তুচ্ছ করে তিনি কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন!
একই ঘটনা ঘটছে এবার করোনা মোকাবিলার সময়েও। সঙ্কটে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। কট্টর বিরোধীরাও তার প্রশংসা করছেন। দেশে করোনা সংক্রমণের সূচনা থেকে শুরু হয়ে গেছে তার ব্যস্ততা। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। দিনে ৭-৮টা মিটিং, সর্বদলীয় বৈঠক, প্রশাসনিক ব্যস্ততা, হাসপাতালগুলিতে সফর, পরিস্থিতির মূল্যায়ন, প্রয়োজনীয় নির্দেশপ্রদান, কেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক। সব মিলিয়ে তার আর নিশ্বাস নেওয়ার সময় নেই। সমস্যা সমাধানে তিনি কত আন্তরিক তা একটা ছোট ঘটনায় বোঝা যায়। করোনা মোকাবিলা নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে তিনি বললেন – মা মারা যাওয়ার পর আমার ভাইয়ের স্ত্রীরা আমার জন্য খাবার করে দিত আবার কখনও কখনও খাবার নিয়ে আসতো। এখন আমি ওদেরও আসতে বারণ করে দিয়েছি।
দেবদেবীর ত্রিনয়নের মত এই তিনজনেরও যেন রয়েছে একটা বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি। যা দিয়ে সবকিছু আলাদাভাবে দেখতে পারেন এরা, পার হয়ে যেতে পারেন সবরকম বাধা। সিস্টার নিবেদিতা, মাদার টেরিজা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের মধ্যে যেন ফুটে ওঠে সেবাধর্মের তিনটি রূপ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত