অনবদ্য ‘চাচা কাহিনী’ লিখেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। বছর দুয়েক আগে। আনন্দবাজার পত্রিকায়। এক জমায়েতে তাঁর চাচা জানতে চেয়েছিলেন ভাইপোর পড়াশোনার খবর। বিদগ্ধ পণ্ডিতের ভাতিজা বলে কথা! সাধারণ জবাবে কি মান থাকে? তাই ভাতিজার জবাব ছিল, ‘তড়ড়ষড়মু’। জবাব শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিলেন বিদগ্ধ কাকা। তার পরে ভরা মজলিসে অবাক হয়ে থাকা মুখগুলোকে স্বাভাবিক করতে কাকা ব্যাখ্যা করে জানিয়েছিলেন, তড়ড়ষড়মু মানে প্রাণিবিদ্যা!
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার। সম্পর্কে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজা। মোয়াজ্জেম আলী তাঁর নিজস্ব চাচাকাহিনিতে শ্রদ্ধেয় কাকাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। সেই সব ঘটনা একই সঙ্গে সরস এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ। একবার একজন আড্ডায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দর্শনপ্রার্থীর বাহন ছিল মার্সিডিজ়। তা দেখে আলী সাহেবের প্রশ্ন, গাড়ির নাম মার্সিডিজ় হল কেন, তা কি আরোহী জানেন? গাড়ির মালিক নিরুত্তর। আলী সাহেব জানান, যিনি প্রথম গাড়ি বানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ের নাম মার্সিডিজ়।
বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলীর পাকাপোক্ত স্থান রম্যলেখক হিসেবে। অবশ্য এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। রম্যর বাইরেও আছে তার সাহিত্য সম্ভার।
মুজতবা-গবেষক নূরুর রহমান খান (মুজতবা-সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য ও রচনাশৈলী, ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত) সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন এভাবে-
ক) হাস্যরস-প্রধান গল্প,
খ) করুণ রসাত্মক গল্প,
গ) বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক গল্প,
ঘ) প্রণয়মুখ্য গল্প,
ঙ) অম্লমধুর গল্প,
চ) ভয়ংকর রসের গল্প।
ভয়ংকর রসের গল্প অবশ্য মাত্র একটি, ‘রাক্ষসী’, যেখানে এক বৃদ্ধার মৃতদেহের বর্ণনা সত্যিই ভয়ংকর।
সৈয়দ মুজতবা আলী গল্প-উপন্যাস লিখতেন, কিন্তু বলতেনই আসলে। যে চারটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন, তার তিনটিই পাঠকদৃষ্টিতে অসাধারণ সৃষ্টি। কেবল শেষ উপন্যাস ‘তুলনাহীনা’ প্রথম তিনটির তুলনায় কিছুটা বিক্ষিপ্ত। এর ঘটনাপ্রবাহ ১৯৭১-এর পটভূমির। কিন্তু প্রথম তিনটি উপন্যাস ঠাসবুনটে লেখা।
শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিতার কর্মস্থল সিলেটের করিমগঞ্জে। পিতা সৈয়দ সিকন্দর আলী ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। পিতার নিবাস ছিল হবিগঞ্জের উত্তরসুর গ্রামে। চাকরিসূত্রে পিতার কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের পর মুজতবা আলী শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতন-এ ভর্তি হন এবং পাঁচ বছর অধ্যয়ন করে ১৯২৬ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্বভারতীতে তিনি বহু ভাষা শেখার সুযোগ পান। সংস্কৃত, সাংখ্য, বেদান্ত, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ফারসি, আরবি, রুশ, ইতালিয়ান, উর্দু, হিন্দি ও গুজরাটি- এমন ১৮টি ভাষায় দখল ছিল তার।
গীতা তার সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল। এমনকী রবীন্দ্রনাথের গীতিবিতানও টপ টু বটম ঠোটস্ত ছিল তার। একবার এক অনুষ্ঠানে এক হিন্দু পুরোহিত গীতা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখছিলেন। সেই সভায় সৈয়দ মুজতবা আলী উপস্থিত ছিলেন। দূর্ভাগ্যক্রমে সেই পুরোহিত যে সব রেফারেন্স গীতা থেকে সংস্কৃত ভাষায় দিচ্ছিলেন তাতে কিছু ভুল ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলী অবশেষে দাঁড়িয়ে উনার সমস্ত রেফারেন্স মূল সংস্কৃত ভাষায় কি হবে তা সম্পূর্ণ মুখস্থ বলে গেলেন। সমস্ত সভার দর্শক বিস্ময়ে হতবাক।
ভারতের অন্যত্র বিশ্বভারতীর ডিগ্রি স্বীকৃত না হওয়ায় মুজতবা আলী প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা পাস করে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে ‘হুমবল্ট’ বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানি গিয়ে বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি দর্শন বিভাগে তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রে গবেষণা করে ১৯৩২ সালে ডি ফিল লাভ করেন। তিনি ১৯৩৪-৩৫ সালে মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এভাবে পড়ালেখায় তিনি প্রচুর সময় কাটিয়েছেন।
মুজতবা আলীর চাকরিজীবন শুরু হয় কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষকরূপে (১৯২৭-১৯২৯)। ১৯৩৫ সালে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হন। তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। পরে পেশার পরিবর্তন করে মুজতবা আলী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের সচিব ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মকর্তা হন। সবশেষে তিনি বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রীডার (১৯৬১) হিসেবে যোগদান করে সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালেই হস্তলিখিত বিশ্বভারতী পত্রিকায় তার কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সত্যপীর, রায়পিথোরা, ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শী ইত্যাদি ছদ্মনামে আনন্দবাজার, দেশ, সত্যযুগ, শনিবারের চিঠি, বসুমতী, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতেন। এ ছাড়া মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, মাতৃভূমি, কালান্তর, আল-ইসলাহ্ প্রভৃতি সাময়িক পত্রেরও তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন।
গ্রন্থাকারে তার মোট ত্রিশটি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে-বিদেশে’, ‘জলে-ডাঙায়’। উপন্যাস ‘অবিশ্বাস্য’, ‘শবনম’। রম্যরচনা ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ময়ূরকণ্ঠী’ এবং ছোটগল্প ‘চাচা-কাহিনী’, ‘টুনি মেম’ ইত্যাদি। তার আরেকটি অনবদ্য গ্রন্থ ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’।
সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থখানি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হইচই ফেলে দেন এবং পাঠকচিত্ত জয় করতে সক্ষম হন। কাবুলে অবস্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অন্তরঙ্গ উপলব্ধির ফসল এই গ্রন্থখানি। সামগ্রিকভাবে তিনি উভয় বঙ্গে সমান জনপ্রিয় ও সমাদৃত লেখক ছিলেন। আন্তর্জাতিক চেতনায় সমৃদ্ধ এই লেখকের বিশ্বমানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং অননুকরণীয় রচনাশৈলী তাকে এই সম্মানের অধিকারী করেছে। তদুপরি তিনি যে নৈপুণ্যের সঙ্গে বিদেশি চরিত্র ও আবহ বাংলা সাহিত্যে এনেছেন তাও তুলনাহীন।
মুজতবা আলী বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন করেছেন এবং বহুজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাই তার লেখায় সে প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তার রম্যবিষয়ক ছোট ছোট রচনা পাঠকদের চিত্তবিনোদন ও অনাবিল আনন্দদানে তুলনাহীন। বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোটগল্পে মানবজীবনের অন্তহীন দুঃখ-বেদনা ও অপূর্ণতার কথা তিনি সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যু হয় এই গুণি লেখকের।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজা সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তার এই গুণি চাচা সম্পর্কে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন- ‘
মুজতবা আমার দাদা-দাদির আদরের ছোট ছেলে। দাদিই নাম দিয়েছিলেন ‘সেতারা’ বা শুকতারা (একটু মেয়েলি কিসিমের নাম), ডাকতেন ‘সিতু’ বলে। কালেক্রমে সেই সিতু মিঞা-ই হলেন বিরাট প-িত ও সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। তাকে গড়েছেন তার মা, বাবা ও সারা পরিবার, বিশেষ করে তার দুই বড় ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলী ও সৈয়দ মরতুজা আলী। যারা লেখাপড়া শেষ করেই সরকারি চাকরিতে ঢুকলেন ও সারা পরিবারের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছিলেন। তাদেরও বিরাট সাহিত্য প্রতিভা ছিল। কিন্তু চাচাকে তারা সংসারের দায় থেকে মুক্তি দিলেন। পড়ালেন দেশে ও বিদেশে। চাচা তার অগ্রজদের এ অবদান কখনও ভুলেননি। স্মরণ করেছেন বারবার ও তাদের উৎসর্গ করেছেন তার অনবদ্য দুটি বই।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী আরও লেখেন- স্বাধীনচেতা মুজতবা আলী সারা জীবন এক ভবঘুরে জীবনযাপন করলেন। কোথাও স্থায়ীভাবে থাকলেন না। স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেন না। পাকিস্তানের কট্টরপন্থীরা তাকে ‘ভারতের দালাল’ অপবাদ দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। কলকাতায় জনপ্রিয়তা, সুনাম ও পুরস্কার সবই পেলেন। তবে কলকাতার রক্ষণশীল লেখক সমাজ তাকে ঈর্ষা করত ও বলে বেড়াত যে, ‘মুজতবা আলীর ধর্ম নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গি একটা আইওয়াশ, আসলে আলী একজন ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট।’ এক দুর্বল মুহূর্তে চাচা দুঃখ করে তার গুণগ্রাহী বিখ্যাত লেখক শংকরকে বলেছিলেন, ‘এক একটা লোক থাকে যে সব জায়গায় ছন্দপতন ঘটায়, আমি বোধহয় সেই রকম লোক।’
‘বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না’ এই ডায়লগটি কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলীর। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের কারণে ১৯৪৯ সালে তিনি অর্জন করেন নরসিং দাস পুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৬১ সালে অর্জন করেন আনন্দ পুরস্কার।
সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গে এক নিবন্ধে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লেখেন-
‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের বাংলা ভাষার অভিধানে ‘কিংবদন্তী’ শব্দটির অর্থ এভাবে দেওয়া হয়েছে: লোক-পরম্পরায় কথিত ও শ্রুত বিষয়। তাহলে কারও পক্ষে কিংবদন্তীর বিষয়ে পরিণত হতে হলে লোকপরম্পরার একটি দীর্ঘ সময়ক্রম প্রয়োজন। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী যে তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীর চরিত্রে পরিণত হলেন, সেটি কী প্রকারে? যাঁরা মুজতবা-সাহিত্য পড়েছেন, তাঁদের কাছে উত্তরটি সোজা- কিংবদন্তী শব্দের ভেতরে বদ্ বা বলার যে বিষয়টি আছে, সেই ‘বলা’ই তাঁকে এই মহিমা দিয়েছে। তিনি বলে গেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাস-কাহিনিগুলো, তাঁর মতো করে; মানুষ তাঁকে নিয়ে বলে গেছে তাদের যা বলার তা; এবং এক (লোক) প্রজন্মে তিনি অর্জন করেছেন এক ঈর্ষণীয় উচ্চতা, যে উচ্চতায় কিংবদন্তীর চরিত্রেরা উড়ে বেড়ায়।’
মুজতবা আলীর পরিচয়ে দু’টি বিশেষণ অবধারিত, রসবোধ এবং প্রবল পাণ্ডিত্য। রসবোধের এমন প্রাবল্য হবে না কেন? রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখায় যে ছাত্রকে বলেছিলেন, ‘ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে!’ মুজতবা আলী শ্রীহট্ট তথা সিলেটের বাসিন্দা। আর সিলেট কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। সে কারণেই এমন সম্ভাষণ। রবীন্দ্রনাথ ও মুজতবা আলীর সংবাদ আরও রয়েছে। শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছেন মুজতবা আলী। ‘রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়তে চাও? আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভাল করে শিখতে চাই। তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী? আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিস বোধ হয় ভাল করে শেখা যায় না। গুরুদেব আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এ কথা কে বলেছে? আমার বয়স তখন সতেরো— থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল। গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়। কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।’
‘অত কথায় কাজ কি, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি, পৃথিবী একডাকে তাকে চেনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী…’ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্ম-পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি। পাণ্ডিত্য আর হৃদয়বেত্তার সঠিক আনুপাতিক মিশেলে যিনি হাস্যরসকে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, কিছুটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বর্ণময় এই মানুষটির জীবন পুরোপুরি রবীন্দ্ররসে জারিত ছিল। আলি সাহেব নিজেই লিখেছেন ‘এ আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমার মনোজগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া…’।
এই বিশিষ্ট মানুষটি শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসেবে আসেন ১৯২১ সালে। তখন মুসলিম ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে অনেক আশ্রমিকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু জহুরির চোখ মহামূল্যবান রত্নটিকে চিনতে ভুল করেনি। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই সব বাধা পেরিয়ে অবশেষে আশ্রমিকের তকমা জুটলো তাঁর। গুরুদেবের সঙ্গে মুজতবা আলির নিম্নোক্ত আলাপচারিতায় সেই সঙ্কটের আভাস কিছুটা পাওয়া যায় –
‘বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?
আমি তো অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে?
হাঁ হাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?’
ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এই কথোপকথনের মূল ভাবনাটি আজ প্রায় শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও একই রকম প্রাসঙ্গিক! রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই আলিসাহেব তাঁর অনন্যতার নজিরটি রেখেছিলেন। গুরুদেব জানতে চাইলেন ‘কি পড়তে চাও?’ ঝটতি জবাব এসেছিল ‘তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভাল করে শিখতে চাই’। যদিও উল্টো দিক থেকে উৎসাহ পেলেন নানাকিছু শিখবার। তাঁর নিজের কথায় ‘কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম’। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য, আশ্রমের শিক্ষা আর বহুমুখী কর্মধারায় অবগাহন করে যেন নবজন্ম হল মুজতবার!
প্রথম প্রথম আশ্রমের অন্যরকম পরিবেশ জল, জঙ্গল, পাহাড়ের দেশ সিলেট থেকে আসা কিশোরটির ভাল লাগছিল না। একটি চিঠিতে লিখছেন ‘একে বাঙাল-খাজা বাঙাল-তদুপরি বাচাল, সর্বোপরি সহজ মেলামেশায় অভ্যস্ত মহিলা মিশ্রিত ব্রাহ্মসমাজ ঘেঁষা তৎকালীন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আবহাওয়া বাবদে সম্পূর্ন অনভিজ্ঞ, বয়স ষোল বছর হয়-কি-না-হয়, চঞ্চল প্রকৃতির মুসলমান ছেলের পক্ষে সে বাতাবরণে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উৎকট সংকট…’। কিছুদিনের মধ্যেই কিন্তু সেই শান্তিনিকেতনই হয়ে উঠল তাঁর অবাধ বিচরণভূমি। আশ্রমের সমস্ত কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয়ভাবে। ‘বিশ্বভারতী সম্মিলনী’র নবম অধিবেশনে (১৯২২) সৈয়দ মুজতবা আলী ইদ উৎসব নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েন। সেদিনের সভার সভাপতি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেই লেখার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। মূলত, গুরুদেবের উৎসাহেই তাঁর ভাবনার স্রোত বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে বেড়াতে লাগল। ‘শিশুমারী’ নামক প্রবন্ধে ভারতে শিশু মৃত্যুর কারণ ও তার প্রতিরোধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। প্রবন্ধ লিখেছিলেন ওমর খৈয়াম সম্পর্কেও। ভাষা শিক্ষার পাঠও চলছিল সমানতালে। রবীন্দ্রনাথের কাছে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্য।
একটি চিঠিতে মুজতবা আলি বলছেন ‘তিন চারদিন হইল রবীন্দ্রনাথ আমাদিগকে ইংরাজী পদ্য পড়ানো আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন…তাঁর পদ্য পড়াইবার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে – অতি নীরস পদ্যও যেন তাঁর কাছে সরস হইয়া যায়’। মুজতবার চিন্তা সর্বদা প্রথাগত পথের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করত। এই মুক্ত চিন্তার পরিসরই তো আশ্রম-শিক্ষার মূল ভাবনা ছিল! বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনো, বাকপটুতা, ‘সেন্স অব হিউমার’ তাঁকে তুমুল জনপ্রিয় করেছিল ছাত্র ও শিক্ষক মহলে। বড় ভাইয়ের পরামর্শে গান শেখাও শুরু করলেন। সেই গল্পটিও কম মজাদার নয়। স্বভাবসুলভ কৌতুক মিশিয়ে লিখছেন ‘একটি ঘণ্টা বসে কেবল সারেগামা-পাধানিসা, সানিধাপামাগারেসা সাধতে হয়। গান যে কোন দিন আরম্ভ হবে তার কোনো দিশে পাচ্ছিনে’।
১৯২৭’শে নন্দলাল বসু অঙ্কিত এবং কবিগুরু স্বাক্ষরিত ‘স্নাতক’ শংসাপত্র নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। বছর দুয়েক কাবুলে কাটিয়ে গেলেন জার্মানি। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত তাঁর কাবুল যাত্রার বিবরণ ‘দেশে বিদেশে’ পড়ে মানস ভ্রমণ করেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই বইটির মাধ্যমেই সৈয়দ মুজতবা আলি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। তাঁর প্রতিটি লেখায় একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য আর রসবোধ দুয়েরই প্রতাপ ছিল প্রবল।
‘বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আমি আসব। যা দেবেন হাত পেতে নেব’ রবীন্দ্রনাথকে কথা দিয়েছিলেন তিনি। এসেছিলেন ফিরে ১৯৫৭ সালে। ১৯৬১-র ১৮ অগস্ট ইসলামের ইতিহাস পড়ানোর কাজে যোগ দিলেন। থাকতেন ৪৫ পল্লির কোয়ার্টারে। আশ্রমিক এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপিকা শ্রীমতী মায়া দাসের (তিনি আলি সাহেবের ছেলে ফিরোজের পাঠভবনের সহপাঠীও বটে) মুখে শুনছিলাম, এক হাতে সাইকেল আর অন্য হাতে পোষ্য অ্যালশেসিয়ান ‘মাস্টারে’র চেন ধরে তাঁর রাজকীয় পদচারনার গল্প। মুজতবা আলি সে সময় খ্যাতির মধ্য গগনে, ফলে বিড়ম্বনাও সইতে হয়েছিল বিস্তর। কিছুটা বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত মুজতবার বিরুদ্ধে ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতি, গবেষণায় গাফিলতি ইত্যাদি অভিযোগ উঠল। উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিরোধ তখন চরমে। অকস্মাৎ ১৯৬৫’র ৩০শে জুন তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অভিমানে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন বোলপুরের নীচুপট্টিতে, আবদুর রউফের বাড়িতে। শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসে অনেকেই ‘চাচা কাহিনি’র লেখককে দেখতে আসতেন। দরজা খুলে নিজেই বলতেন ‘আলি সাহেব তো বাড়ি নেই’। চিঠিপত্রে লিখতেন ‘শ্মশান, শান্তিনিকেতন’। খেদোক্তি করেছিলেন ‘শান্তিনিকেতনের শান্তিতো গুরুদেবর লগে লগে ঐ গেছে গিয়া…’।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় পাকিস্থানের গুপ্তচর সন্দেহে পুলিশি হেনস্থার মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। হিন্দুধর্ম এবং ইসলামের সার বিষয়টি আত্মস্থ করেছিলেন। মহাভারত তাঁর অন্যতম প্রিয় গ্রন্থ। স্বভাবতই, এই অবিশ্বাস, অপমান বড় বেজেছিল হতাশাগ্রস্ত মানুষটির মনে! শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে চাননি। ভাগ্যের পরিহাসে তাঁকেই ১৯৭৪ এর ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে চিরনিদ্রায় চলে যেতে হল!
‘রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের নেই’ বলেছেন ‘রবির বিশ্বরূপ’ প্রবন্ধে। লিখলেন ‘রবীন্দ্রনাথকে সে-ভাবে দেখবার মত মনীষী এখনও এ জগতে আসেননি… বড় বাসনা ছিল, মৃত্যুর পূর্বে তাঁর বিশ্বরূপটি দেখে যাই…’ এ যেন গুরুর প্রকৃত স্বরূপ জানবার জন্য সমর্পিত এক শিষ্যের চিরকালীন আকুতি! প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রশতবর্ষে (১৯৬১) শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠান নিয়ে আক্ষেপ করে চিঠি লিখছেন ‘বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথকে কেউ স্মরণ করেনি। করেছে পোয়েট টেগোরকে…’।
তাঁর গুরুভক্তির উদাহরণ হিসেবে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলা যায়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রখ্যাত লেখক শংকরের সঙ্গে আলি সাহেবের দেখা হয়। সেই সাক্ষাতের বিবরণ লেখকের কলমে –
‘আমার হাত চেপে ধরে আলি সায়েব বললেন, “শংকর, মনে হচ্ছে স্মৃতি লোপ পাচ্ছে। তুমি একবার ‘সঞ্চয়িতা’খানা ধরো তো-ব্যাপারটা একটু খুঁটিয়ে দেখি।” ওঁর ক্লান্ত মলিন মুখে হঠাৎ হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল।’
সেদিন আবৃত্তি করেছিলেন ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ একবারও না থেমে এবং নির্ভুল ভাবে। ‘সঞ্চয়িতা’র প্রতিটি কবিতার ‘পোয়েটিক ট্রান্সলেশন’ করে বিচরণ করতে চেয়েছেন কবি মানসে। ‘তারা-ঝরা নির্ঝরের স্রোতঃপথে পথ খুঁজি খুঁজি/ গেছে সাত-ভাই চম্পা…’ এর অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজতে গিয়ে পড়ে ফেললেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবদুল জব্বারের ‘তারা-পরিচিতি’। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এভাবেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার এবং পুনরাবিষ্কার করে গিয়েছেন। এই হয়তো ছিল তাঁর গুরুদক্ষিণা!
এই সম্ভব-অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলই বোধহয় মার্সিডিজ়ের নামকরণ, হটেনটট জাতির বৈশিষ্ট্য বা ওড়িয়া বর্ণপরিচয়ের পাঠকৌশল নিয়ে ভিয়েন বসানো। হটেনটট আফ্রিকার এক জনজাতি। তারা নাকি সহজে নতুন কোনও কিছু গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। আলী সাহেবের লেখায় বেশ কয়েক বার পাওয়া যায় শব্দটি। এখন যদিও শব্দটিকে বর্ণবিদ্বেষমূলক বলে মনে করা হয়। কিংবা সেই ‘ঔড্র কায়দায়’ বর্ণপরিচয়, ‘ক’রে কমললোচন শ্রীহরি, খ’রে খগ আসনে মুরারি, গ’রে গরুড়…’ এর সঙ্গে যোগ করতে হবে দেশ-বিদেশের রসবতীতে তাঁর উঁকিঝুকি আর রসনা তৃপ্তির পরে সরস বর্ণনার কথা। হাঙ্গেরিয়ান গুলাশের কথা জানা ছিল। শব্দটা মিলেছিল এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য ব্ল্যাক ওবেলিস্ক’ উপন্যাসে। আলী সাহেব জানালেন, এই হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ আর কিছুই নয়, আমাদের বাংলার মাংসের ঝোল। ইতালির রিসোত্তো খেয়ে পাড়া মাত করায় বাহাদুরি নেই। তার সঙ্গে যে পোলাওয়ের তফাত নেই তেমন। কিংবা কায়রোর সেই চাক্তি চাক্তি মাংস, মধ্যিখানে ছেঁদা? ‘দাঁতের তলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কাটে বটে’ কিন্তু স্বাদে উমদা। তা যে আমাদের চির পরিচিত শিক কাবাব, সে তো আলী সাহেবের কাছ থেকেই শেখা। এ সবই সেই ‘অনেক কিছু শিখতে হবে’র সিদ্ধান্ত।
মুজতবা আলীর লেখায় যে বহুমুখী জিজ্ঞাসা, জ্ঞানস্পৃহার আভাস, তা বিশ্বভারতীর আবহাওয়ার দান, লিখেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী রসিকতা করে অধ্যাপক শব্দটি উচ্চারণ করতেন ‘আড্ডাপক্ব’ বলে। তাঁর ব্যাখ্যায়, আড্ডায় পক্ব না হলে অধ্যাপনায় যোগ্যতা অর্জন করা যায় না। মুজতবা আলী সে বিষয়ে সুসিদ্ধ এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন। অনর্গল তাঁর বাক্যস্রোত। কবিধামে নবাগতরাও তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। ‘শান্তিনিকেতনের অন্যান্য দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে তিনিও একটি দর্শনীয় সামগ্রী হয়ে উঠেছিলেন।’ একবার একটি দলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘শান্তিনিকেতনে এসেছ কী কী দেখতে? ক্ষিতিমোহনবাবুকে দেখেছ? ওরা বললে, দেখেছি। নন্দলাল বসুকে? হ্যাঁ, দেখেছি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে? তাঁকেও দেখেছি।’ তার পরেই তাঁর উক্তি, ‘ওঃ বাঘ সিংহ সব দেখে, এখন বুঝি খট্টাশটাকে দেখতে এসেছ।’
নিজেকে নিয়ে এমন রসিকতা বহু বার করেছেন তিনি। একটি লেখায় নিজের বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘অত্যন্ত রোগা, সিড়িঙ্গে, গায়ের রং ছাতার কাপড়কেও লজ্জা দেবে এবং তোতলা, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে থুতু ছোটে।’ যদিও ছিলেন কন্দর্পকান্তি। তবে মধ্য বয়সের ইন্দ্রলুপ্তময় মুজতবার ছবিই আমাদের বেশি পরিচিত। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক মহম্মদ আবদুল ওয়ালী। একবার এই চিকিৎসক কলকাতার নামকরা কলেজের প্রাণিবিদ্যার এক অধ্যাপককে নিয়ে গিয়েছিলেন মুজতবা আলীর সঙ্গে পরিচয় করাতে। অধ্যাপককে দেখে মুজতবা আলীর জিজ্ঞাসা, ‘হঠাৎ এখানে এসে হাজির কেন?’ এমন জিজ্ঞাসায় অধ্যাপক একটু জড়সড়। ডাক্তার জানান, পরিচিত হওয়ার আগ্রহে এসেছেন। আলীসাহেব বললেন, ‘না! না! না! আসল মতলবটা হল এই চ্যাংড়া অধ্যাপকের রিসার্চ সেন্টারে জন্তু জানোয়ারের নিশ্চয় কিছু অভাব ঘটেছে। তাই আমাকে দেখতে এসেছে। পছন্দ হয় কি না?’
হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মনে হয়েছে, শান্তিনিকেতনের বুধমণ্ডলীর মজলিসে আড্ডাপক্ব হয়েই মুজতবা আলী অনর্গল। কিন্তু তিনি নিজে কী মনে করতেন? প্রমাণ দাখিলে মহম্মদ আবদুল ওয়ালীর সাক্ষ্যই মানা যাক। তিনি লিখেছেন, প্রথম সাক্ষাতের সময়ে তিন দিন নানা বিষয়ে অবিরাম কথা বলেছিলেন আলীসাহেব। তার পরে নিজেই বললেন, ‘এই যে তোমার সাথে বকবক করলাম— এর জন্য আমি বিন্দুমাত্র দায়ী নই। এর পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে।’ সে ইতিহাস সটিক। পাড়ায় যিনি টিকে দেন, তাঁকে আলীসাহেবের মা বলেছিলেন ছুটির দিনে বাচ্চাদের টিকে দিতে। বাড়িতে মা ছুটির আগের দিন জানালেন, কালকে সকালে ছেলেমেয়েরা নারকেল মুড়ি খাবে।
পরের দিন আলীর ভাই-বোনেরা সকলে মিলে নারকেল মুড়ি খাচ্ছেন ঘরে বসে। মা দরজার একটি পাল্লার শিকল তুলে দিয়ে দোরগোড়ায় বসে। টিকাদার এলেন। তিনিও নারকেল মুড়ি পেলেন। নারকেল-মুড়ি খাওয়ার আনন্দে টিকাদারের উপস্থিতি গ্রাহ্যই করেননি মুজতবা আলী। খাওয়া শেষ হলে মা যখন জিজ্ঞেস করলেন টিকে দেওয়ার যন্ত্রপাতি এনেছেন? টিকাদার জানালেন, ল্যানসেটটা আনতে ভুলে গিয়েছেন। সুগৃহিণী মা বললেন, ‘বোস, আমি ব্যবস্থা করছি।’ কিছুক্ষণ পরে তিনি ‘হিজ় মাস্টার্স ভয়েস’-এর গ্রামোফোনের পিন নিয়ে হাজির। টিকেদারকে পরামর্শ দিলেন, ‘এই পিনগুলো স্পিরিটে পুড়িয়ে লিম্প দিয়ে চিরে চিরে টীকে দিয়ে দে।’ গল্প শেষ হল। মুজতবা আলী ডাক্তারকে বললেন, ‘বুঝলে ডাক্তার! ঐ যে আমাকে রেকর্ড-পিন দিয়ে টীকে দেওয়া হলো, সেই থেকে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ইয়োর্স ফেথফুল সার্ভেন্টের মত সারা জীবন বকেই চলেছি।’
সে বকা ‘ফালতো’ নয়। খুব সাধারণ ঘটনা থেকে রসসঞ্চার করতে পারতেন। একবার পুজোর ছুটিতে আলীসাহেবের সঙ্গে একদল ভক্ত কলকাতায় ফিরছেন। সঙ্গে সেই ব্যক্তিগত চিকিৎসক। স্টেশনে এসে জানা গেল, ট্রেন ৪৫ মিনিট দেরিতে চলছে। মুজতবা আলী প্রস্তাব দিলেন, রেস্তরাঁয় গিয়ে সময় কাটানো যাক। কিন্তু খেতে খেতেই হঠাৎ ট্রেনের বাঁশির শব্দ। দলের কেউ বলে উঠেছিলেন, ‘ওই বোধহয় ট্রেন এসেছে।’ খাওয়াদাওয়া ফেলে সকলে দ্রুত প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু স্টেশনে তখন ঢুকেছে মালগাড়ি। মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারি পরিভাষায় একে কী বলে? ডাক্তার উত্তর দিতে পারেননি। রসিক মুজতবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘একেই বলে ফলস লেবার পেন।’
কিংবা সেই বিয়েবাড়ির ঘটনা। মজলিস জমাতে মুজতবা আলীর জুড়ি ছিল না। যথারীতি এক বিয়েবাড়িতে তাঁকে ঘিরে আসর জমে উঠেছে। নতুন আত্মীয়স্বজন জামাইয়ের সঙ্গে শাশুড়ির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। শ্যালক-শ্যালিকারা নতুন জামাইয়ের সঙ্গে মশকরা করছে। হঠাৎ জামাই শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আপনি কিছুক্ষণ আগে জলে পড়ার কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছেন কি?’ শাশুড়ি কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। খোলসা করলেন জামাই, ‘অগ্নিসাক্ষী করে এই যে আপনি আপনার মেয়েকে জলে ফেলে দিলেন, তার কি কোনও আওয়াজ শুনতে পাননি?’
গুরুগম্ভীর বিষয়ও তাঁর উপস্থাপনায় হয়ে উঠত রসগ্রাহী। বিভিন্ন জাতি নিয়ে তাঁর সরস গল্প আছে বহু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো গম্ভীর বিষয়। প্রবল লড়াই চলছে তিন জাতির মধ্যে। জাতিগুলি হল, ফরাসি, জার্মান আর ইংরেজ। এক বৃদ্ধ শিখ মেজর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর খবরে একটু বিমর্ষ। তিনি প্রতিপক্ষ কারা জানতে চাইলেন। জানানো হল, ইংরেজ আর ফরাসিরা মিলে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়ছে। সর্দারজি একটু আক্ষেপ করলেন, কোন দেশ হারলে বিশ্বের কী ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে। তাঁর আশঙ্কা, ফরাসি হারলে দুনিয়া থেকে সৌন্দর্যের চর্চা উঠে যাবে। আর জার্মানি হারলেও খারাপ। কারণ বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান কলাকৌশল শেষ হয়ে যাবে। আর ইংরেজ হারলে? সর্দারজি চুপ। চাপাচাপিতে বললেন, ইংরেজ হারলে দুনিয়া থেকে বেইমানি লোপ পেয়ে যাবে।
আবার জাতিতত্ত্ব। আর একটি গল্প। চারটি জাতির পরিচয় এক একটি বাক্যে এঁকে ফেলেছিলেন। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি, ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান আর স্কচেরা কেমন! জাতিতত্ত্বের রস কেমন করে জারিয়েছিলেন? একবার চার জন মিলে চড়ুইভাতি করার পরিকল্পনা করল। ঠিক হল সকলে কিছু না কিছু আনবে। কথা মতো ইংরেজ আনল বেকন আর আন্ডা। ফরাসি নিয়ে এল এক বোতল শ্যাম্পেন। জার্মান নিয়ে এল ডজনখানেক সসেজ। কিন্তু স্কচ বন্ধু সঙ্গে নিয়ে এল ভাইকে। প্রচলিত যে, স্কচেরা নাকি ভীষণ কঞ্জুষ হয়!
এমন রসিক মানুষটি ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? ডাকাবুকোই ছিলেন। দাদা মুর্তাজা আলী ভাইয়ের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন একটি লেখায়। তখন মুজতবা আলীর বয়স চার বা পাঁচ বছর। ইনস্পেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন মিস্টার জে হেজলেট চাড়াভাঙ্গা গ্রামে আলী সাহেবদের বাবার দফতর পরিদর্শনে আসেন। সেই সময়ে নির্জন এক গ্রামে ইংরেজ সাহেবের আসার খবরে বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা। অফিসের চারপাশে মেলার ভিড়। সাহেব বারান্দায় বসে এক মনে কাগজপত্র দেখছিলেন। তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়িটি বেশ দামি। সকলের নজর এড়িয়ে ছোট্ট মুজতবা সাহেবের ঘড়িটি হাত দিয়ে পরখ করতে চেয়েছিলেন। হেজলেট ‘অমায়িক’ ব্যক্তি। তিনি হেসে ছেলেটির পরিচয় জানতে চাইলেন। বাবা কাছেই ছিলেন। পরিচয় দিলেন। তিনি একটু লজ্জিত ছেলের আচরণে। কিন্তু সাহেব পরিষ্কার জানালেন, ‘নেভার মাইন্ড, হি উইল বি আ জিনিয়াস।’
ছোট্ট মুজতবার এ রকম কীর্তি আরও রয়েছে। তখন সুনামগঞ্জের পাঠশালার ছাত্র। প্রথম বার্ষিক পরীক্ষায় তাঁকে একটি কঠিন শব্দের বানান জিজ্ঞেস করা হয়। মুজতবা জানান, তিনি বানান করতে পারবেন না। কিন্তু বোর্ডে লিখে দিতে পারবেন। শিক্ষক তো অবাক এমন চটজলদি জবাবে।
মুজতবা আলীর ডাকনাম ছিল ‘সিতারা’। কাছের মানুষেরা ডাকতেন ‘সীতু’ বলে। নিজের লেখার ভণিতায় এই নামটি ব্যবহারও করেছিলেন। সেই যে মজার ‘মার্জার নিধন কাব্য’। বিয়ের প্রথম রাতেই বিড়াল মারার জনপ্রিয় গল্পটির কাব্যরূপ। তবে ভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে। ওই কাব্যের ভণিতায় লিখেছিলেন, ‘দীন সীতু মিয়া ভনে, শুনে পুণ্যবান’। ‘সিতারা’ মানে তো নক্ষত্র। ছোটবেলাতেই তাঁর তারকা হওয়ার গুণ বেশ প্রকট ছিল।
পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন মুজতবা আলী? তার একটি ছবি এঁকেছেন প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায়। সেই কাহিনি ‘শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা’ প্রকাশ নিয়ে। বইটির প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ তথা ভানুবাবুদের প্রকাশনা সংস্থা। তা বইয়ের জন্য চুক্তি হল। আলী সাহেবের কথা মতো চুক্তির কিছু দিন পরে প্রকাশক দল বেঁধে গেলেন শান্তিনিকেতনে। আলী সাহেব তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তার পরে স্ত্রীকে ডাকতে শুরু করলেন, ‘ও বৌ, এসে দ্যাখো, আমার কলকাতার পাবলিশাররা এসেছে।’ স্ত্রী তো এমন সম্বোধনে অতিথিদের সামনে সংকুচিত। একটু কুণ্ঠিত ভাবে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, উনি বৌ বৌ করে এমন ডাকেন, যাঁরা আসেন তাঁরা এবং আমি সবাই লজ্জায় পড়ি।’
ভানুবাবু আরও মজার ঘটনা লিখেছেন। দ্বিতীয় মজা মামলা নিয়ে। মুজতবা আলীর প্রথম প্রকাশকের সঙ্গে ঝামেলা। তা নিয়ে মামলা হয়। আইনজীবীর দরকার হয়ে পড়ে তাঁর। তিনি যান ব্যারিস্টার তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মুজতবা আলী প্রথম সাক্ষাতেই বলেন, ‘ভাই, আমি এমন একজন কৌশুলী চাই, যে আমার এই মামলাটায় আমায় হারিয়ে দেবে।’ তাপসকুমার ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ফলে তাঁর হাজির-জবাব, ‘আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আমি এখনও পর্যন্ত একটা মামলাতেও জিতিনি।’ এমন সরস সংঘর্ষে বন্ধুত্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক। আলী সাহেব প্যারীবাবুর বাড়িতে এলে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন ব্যারিস্টারের বাড়ি।
একদিন এ রকমই আড্ডা জমেছে ব্যারিস্টারের বাড়ি। সে দিনই অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী এমা সরস এক অভিযোগ করে গিয়েছেন। তারাপদ এবং বন্ধু স্নেহাংশু আচার্য একদিন তাঁদের বাসস্থানের দোতলায় গল্প করছিলেন। এমা চা-জলখাবার নিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে এল, টেপ রেকর্ডারে চলছে খেমটা জাতীয় গান। যাতে প্রচুর আদি রসাত্মক শব্দ। গানের কান লাল করে দেওয়া শব্দ শুনে এমার হাত থেকে খাবারদাবার সব পড়ে গেল। তারাপদ এবং স্নেহাংশু ছুটে এলেন এমা পড়ে গিয়েছেন ভেবে। কিন্তু এমা রেগে গিয়ে প্রবল ভর্ৎসনা করলেন দু’জনকে। ভদ্রলোকের ছেলেরা এ সব শুনছে! ওঁরা যতই বলেন, এটা নির্দোষ আমোদ, এমা শুনতে নারাজ।
গল্পের শেষে সুতো ধরলেন আলী সাহেব। তিনি আইনজীবীকে বললেন, ‘ব্রাদার, তুমি একবার তোমার এখানে আমার আর দোদের (স্নেহাংশু আচার্য) লড়াই লাগাও। আমার কাছে কলাবাগানের যা স্টক আছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার দোদেদা পয়লা ইনিংসেই উড়ে যাবেন।’ আলী সাহেবের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার গল্প তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের বার লাইব্রেরিতে করেছিলেন। দু’-চার দিন পরে তাপসবাবুর কাছে এক জজসাহেবের চিরকুট এল। তাপসবাবু গেলেন। তিনি যেতেই জজ সাহেব দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। তাপসবাবু অবাক। জজসাহেব জানালেন, তিনি শুনেছেন স্নেহাংশু আচার্য এবং আলী সাহেবের ‘কী সব তরজা’ হওয়ার কথা। তাই জজসাহেব নিজের এবং বন্ধুর জন্য দুটো সিট বুক করতে চাইছেন। তাপসবাবু জানান, ও সব আলী সাহেবের কীর্তি। তাঁর বাড়িতে এমন তরজার আসর বসানোর কোনও জো নেই। আলী সাহেবের রসবোধের সুতো যে কী ভাবে লোকজনকে জড়িয়ে ধরত, এটা তারই একটা উদাহরণ।
শুধু কি বিদগ্ধ শ্রোতাদের কাছেই মুজতবা আলী তাঁর রসের প্রবাহ অনর্গল করতেন? তা কিন্তু নয়। তাঁর অনন্য রসবোধ থেকে বঞ্চিত করতেন না ছাত্র-ছাত্রীদেরও। তাতে অবশ্য কখনও কখনও সেই রসের সঞ্চারে শিষ্য বা শিষ্যার গাল লাল হয়ে যেত। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছিলেন সেই লালিমা ছাত্রীর কথা। ঘটনাস্থল শান্তিনিকেতন। রঙ্গমঞ্চ কালোর চায়ের দোকান। সেখানে উপস্থিত এক ছাত্রী। তিনি জার্মান ভাষা নিয়ে সদ্য পাশ করেছেন। আলী সাহেবও তখন জার্মান পড়াতেন। বিশ্বভারতীর কোনও অধ্যাপক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটির সঙ্গে। তার পরেই আলী সাহেবের করাঘাত, ‘ইস, আমি জার্মান পড়াতে এলুম আর সুন্দরী তুমি বেরিয়ে গেলে। আচ্ছা দেখি কী রকম জার্মান শিখেছ। একটা খিস্তি করো তো জার্মান ভাষায়। ভয় নেই, কেউ এখানে বুঝবে না।’ আলী সাহেব এ রকমই। শোনা যায়, জার্মান ভাষায় মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার সময়েও ছাত্রীদের এই রকমই কান লাল করা প্রশ্ন করতেন।
আলী সাহেবের কথা লিখতে গেলে তাঁর পাণ্ডিত্য, রসবোধ, বাগবৈদগ্ধ্যের কথাই আলোচিত হয় বেশির ভাগ সময়ে। মানুষ অবশ্য এতেই বেশি প্রভাবিত হন। মনেও রাখেন মজার মজার সব ঘটনা। কিন্তু হাসি-মজায় মাতিয়ে রাখা মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। যা ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর সম্পদ। সেই গল্পও শোনা যেতে পারে। তখন তিনি নবম শ্রেণিতে পড়েন। স্কুলের সরস্বতী পুজোয় বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলেন প্রশাসনিক এক বড় কর্তার বাংলোয় ফুল পাড়তে। ধরা পড়ে যান। ফলে স্কুল থেকে বিতাড়ন। অন্য দুই ছাত্র ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ফলে তারা স্কুলে ফিরতে পারে। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় দাদা মুর্তাজা আলীর লেখায়। তিনি জানিয়েছেন, ওই বাংলো ছিল ডেপুটি কমিশনারের। নাম জে এ ডসন। তিনি দোষী ছেলেদের ডেকে পাঠান। ছেলেরা গেলে তাঁর চাপরাশি পড়ুয়াদের দু’-এক ঘা বেত মারে। সালটা ১৯২১। দেশ অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল। আলী ছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র এবং ক্লাসের ফার্স্ট বয়। মারের প্রতিবাদে ছাত্ররা ধর্মঘট করল। যে সকল সরকারি চাকুরের পরিবারের ছেলেরা ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল, তাদের অভিভাবকদের উপরে কর্তৃপক্ষ চাপ দিতে শুরু করলেন। আলী সাহেবের বাবা তখন ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্ট্রার। অসমে অবশ্য পদটির নাম ছিল স্পেশ্যাল সাব রেজিস্ট্রার। ডেপুটি কমিশনার বাবাকে ডেকে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। বাবা মুজতবাকে স্কুলে ফিরে যেতে বললেও, তিনি রাজি হননি। রাজনৈতিক আবহ থেকে ছেলেকে সরাতে ঢাকার দক্ষিণে কাজী সাহেবের গেঞ্জি বোনার কলে পাঠালেন বাবা। অবশ্য এর কিছু দিন পরে মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ পান।
ছাত্রজীবনে হাতে লেখা পত্রিকা করেছিলেন দাদা মুর্তাজা আলীর সঙ্গে। নামটা সাংঘাতিক— ‘কুইনিন’! পত্রিকার আদর্শ, অপ্রিয় সত্যভাষণ। কিন্তু পত্রিকাটি বেশি দিন চালাতে পারেননি দুই ভাই। এই দৃঢ়চিত্ততার জন্য নানা সময়ে বিপাকেও পড়তে হয়েছে মুজতবা আলীকে। তখন তিনি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ। একবার এক সভায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ ইকবালের চেয়ে অনেক বড় কবি। তা নিয়ে শুরু হল প্রবল বিতণ্ডা। মৌলবাদী ছাত্ররা প্রবল ক্ষিপ্ত। মারধর খাওয়ার আশঙ্কা। আলী সাহেবের মেজদা সৈয়দ মুর্তাজা আলি বগুড়া জেলার জেলাশাসক তখন। তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। কিন্তু বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দেন।
আর এক বারের ঘটনা শান্তিনিকেতনে। ৭ই পৌষের উপাসনায় ছাতিমতলায় তিনি আচার্য হয়েছিলেন। পরে এসেছিলেন শেরওয়ানি চোস্ত এবং ফেজ। শান্তিনিকেতনের রক্ষণশীলদের কাছে সে জন্য তাঁকে কটূক্তি শুনতে হয়। যদিও তাঁর এই ভাবনাকে স্বাগত জানানোর মতো উদারচিত্ত লোকের অভাব ছিল না।
মুজতবা আলীর চাকরিজীবন শুরু হয় ১৯২৭ সালে কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষকরূপে। বরোদার মহারাজ সয়াজী রাও-এর আমন্ত্রণে ১৯৩৫ সালে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হন। তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। পরে পেশার পরিবর্তন করে মুজতবা আলী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের সচিব ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মকর্তা হন। সবশেষে তিনি ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করে সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ মুজতবা আলী। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালে হস্তলিখিত বিশ্বভারতী পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সত্যপীর, রায়পিথোরা, ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শী ইত্যাদি ছদ্মনামে আনন্দবাজার, দেশ, সত্যযুগ, শনিবারের চিঠি, বসুমতী, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতেন। এছাড়া মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, মাতৃভূমি, কালান্তর, আল-ইসলাহ্ প্রভৃতি সাময়িক পত্রেরও তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। গ্রন্থাকারে তাঁর মোট ত্রিশটি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- দেশে-বিদেশে, জলে-ডাঙায়, উপন্যাস অবিশ্বাস্য, শবনম, পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকণ্ঠী এবং ছোটগল্প চাচা-কাহিনী, টুনি মেম প্রভৃতি। মুজতবা আলীর ডি.ফিল অভিসন্দর্ভটি বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ তাঁর আরেকটি অনবদ্য গ্রন্থ।
সৈয়দ মুজতবা আলী দেশে-বিদেশে গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রথম প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গ্রন্থখানি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠক মনে নাড়া দিতে সক্ষম হন। কাবুলে অবস্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অন্তরঙ্গ উপলব্ধির ফসল এ গ্রন্থখানি। দেশে-বিদেশে উপন্যাস নাকি ভ্রমণ কাহিনী এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন গ্রন্থটিকে ভ্রমণ-উপন্যাস বললে খারাপ বলা হবে না। ভ্রমণ-উপন্যাসটিতে ভ্রামণিক অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প আকারে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন দক্ষ শিল্পীর কৌশলী আঁচড়ে। বইটিতে লেখক ভূগোল ও প্রকৃতির বিবরণ, জীবন ও সংস্কৃতির বিশেষণ এবং মানবগতির বিচিত্র স্বভাবের যে অনুপুঙ্খ, হৃদয়গ্রাহী ও আনন্দঘন উপস্থাপনা করেছেন, তাতে তার চিন্তা এবং পরিবেশনশৈলীর নৈপুণ্যে পাঠক বিস্মিত না হয়ে পারে না। দেশে-বিদেশে হয়তো তার জীবন-অভিজ্ঞতার এক বিশ্বস্ত বিবরণ; সে অর্থে এটি জীবন-ঘনিষ্ঠ সাহিত্যের কাতারে দাঁড়াতে পারে অনায়াসে। গ্রন্থটিতে ভ্রমণের আনন্দ ও অজানাকে জানবার সুধারসের পাশাপাশি গভীর পর্যবেক্ষণের অনুভবে পরিবেশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাল হকিকত। আফগান, হিন্দুস্থান, ইরান কিংবা চীন বিষয়ে ইংরেজদের মনোভাব ও রাজনৈতিক অভিপ্রায় কী, তারও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ধরা পড়ে লেখকের বর্ণনায়। স্বাধীন আফগানের মানুষের জীবনের চালচিত্র প্রকাশ করতেও তিনি কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করেননি। জীবন-অভিজ্ঞ সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে বইটিতে কিছু প্রবাদবাক্য পাঠকের নজর কাড়ে। ‘কোনো দেশের গরিব মেয়েই পর্দা মানে না, অন্তত আপন গাঁয়ে মানে না।’ ‘ইংরেজ এবং অন্য হরেক রকম সাদা বুলবুলিকে আফগান পছন্দ করে না।’ ‘পরের অপকার করিলে নিজের অপকার হয়।’ ‘বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক, বাজে তর্কে খুব মজবুত।’
অনুরূপ রসগোল্লা রম্যগল্পের কাহিনীটাও চমৎকার। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঝান্ডুদা বন্ধুর মেয়ের জন্য এক টিন ভ্যাকুম প্যাকেটজাত মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন। ইতালির কাস্টমস ঘরে কাস্টমস অফিসারের সাথে তা নিয়ে বাকবিত-া হয়। কাস্টমস কর্মকর্তাকে তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হন যে, প্যাকেট খুললে মিষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। কাস্টমস অফিসারের ভাঙাচোরা চেহারার বর্ণনা আমাদেরকে রসগোল্লা খাওয়ার আগে রসে মজিয়ে ফেলে। তাছাড়া ঝান্ডুদার পোশাক ব্যাগের উপরে বিভিন্ন দেশের কাস্টমস হাইজের সিল সব কিছুতে রসের প্রাচুর্য আছে। সেখানে নানা হাস্যরসাত্মক কা- ঘটানোর পরেও ঝান্ডুদাকে মিষ্টান্নর প্যাকেট খুলতে হয়। আর প্যাকেট খোলার পরে ঘটে সেই আসল ঘটনা। একগুয়েমি কর্মকর্তার একগুয়েমিতার কারণে ঝান্ডুদা প্যাকেট খোলে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝান্ডুদা ক্ষেপে রসগোল্লা নিয়ে চুঙ্গিওয়ালার নাকে-মুখে লেপে দেয়। আর সকলকে রসগোল্লা দেয়। রসগোল্লার রসে মজে ফরাসি উকিল আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। সকলেই রসগোল্লার রসে মজে আবার রসগোল্লা খেতে চায় কিন্তু ততোক্ষণে তা শেষ। এই রম্য রচনার প্রতিটি চরিত্র হাস্যরসের উদ্রেগ করে। কাহিনীটা সাধারণ হলেও পাঠকের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনে নানা ধরনের চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছিল। তাঁর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায় সেটা কখনোই ছিল না। তিনি কখনও চাকরি করেছেন, কখনো লিখে টাকা আয় করেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক চাকুরি চেয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক কারণে তখন তাঁদের চাকুরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। আনন্দবাজার গ্রুপও তাঁকে চাকুরি দেননি। পরে, শান্তিনিকেতনে মুজতবার চাকুরি হয়”। শুধুমাত্র কলমকে ভরসা করে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সালের অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত, হালভাঙা নৌকোর মত কোনোক্রমে নিজেকে চালিয়েছেন।
মুজতবা আলী বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন করেছেন এবং বহুজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাই তাঁর লেখায় অনুরূপ বহুদর্শিতা ও নিবিড় অনুধ্যানের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর রম্যরচনাবিষয়ক ছোট ছোট রচনা পাঠকদের চিত্তবিনোদন ও অনাবিল আনন্দদানে সমর্থ হয়েছে। আবার এ কথাও ঠিক যে, তিনি হাসির আবরণে অনেক সময় হৃদয়ের গভীরতর সত্যকে উদঘাটন করেছেন। তিনি জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বিবিধ ভাষা ও শাস্ত্র থেকে এসব উপাদান আহরণ করেন। বিশেষকরে উপন্যাস ও ছোটগল্পে মানবজীবনের অন্তহীন দুঃখ-বেদনা ও অপূর্ণতার কথা তিনি সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন।
এমন রসিক মানুষটির শেষ জীবন কেটেছে ভীষণ কষ্টে। অমিতাভ চৌধুরী ১৯৯৩ সালে একটি লেখায় লিখছেন, ‘সৈয়দদাকে শেষ দেখি কলকাতায় তাঁর পার্ল রোডের বাড়িতে। সুশীলা আসার নামে শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন ছাত্রী কিছু গুজরাতি আচার দিয়েছিলেন… ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আচারের শিশি দিতে গিয়ে সৈয়দদার চেহারা আর পোশাক দেখে আমি অবাক। ছেঁড়া গেঞ্জি, নোংরা পাজামা এবং দিন তিনেক অন্তত দাড়ি কামানো হয়নি। সুপুরুষ মানুষের এই অবস্থা। আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল।’ এর পরে অনেক কথা হয় দু’জনের। আলী সাহেব তখন কাশছেন ঘন ঘন। ‘কিন্তু কথায় কোনও ছেদ নেই।’ আড্ডা দিতে দিতেই বলেছিলেন, ‘দর্পহারী মধুসূদন একে একে সব কেড়ে নিচ্ছেন আমার। হাতের কলম সরে না, লিখতে কষ্ট হয়, আর না লিখতেই যদি পারি, তবে বেঁচে কী লাভ?’
মাঝেমাঝে শারীরিক সঙ্কটের জন্য আক্ষেপ করতেন বটে। কিন্তু ভাঙা শরীরেও রসপ্রবাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। তার সাক্ষী সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। এক সময়ে কুকুর পুষেছিলেন। অ্যালসেশিয়ান। পোষ্যটিকে ‘মাস্টার’ বলে ডাকতেন। কেন? কারণ তার প্রভু তিন গেলাসের বেশি খেতে আরম্ভ করলেই মাস্টার ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে শুরু করত। মানে প্রভুর উপরে মাস্টারি করত। মুজতবা আলী বলতেন, ‘গত জন্মে এ ব্যাটা নিশ্চয় আমার চাচা ছিল।’
বাংলা রসসাহিত্যের সেরা দুই শিউলির শেষ জীবনটা মোটেও সুখের ছিল না। একজন মুজতবা আলী। অন্য জন শিবরাম চক্রবর্তী।
পরিশেষে বলা যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর যে প্রতিভা, যে জ্ঞান ছিল তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যেতে পারেননি বলে অনেকেই মনে করেন। ভয়ংকর অলসতার কারণে তিনি নিজকে নিজেই ঠকিয়েছেন। সুনীতি বাবু বলেছেন, “মুজতবা আলী তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের প্রচ- গবেষক হতে পারতেন, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে সার্থক অন্বেষণ চালাতে পারতেন, ভারতীয় ইতিহাসের অনুদ্ঘাটিত দিক উন্মোচন করতে পারতেন, কিন্তু কিছুই করেন নি। শুধু ব্যঙ্গ রসিকতায় নির্বাসন দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করলেন।” ভীষণ অগোছালো ছিলেন তিনি। মুজতবা নিজেই লিখেছেন ‘হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না, আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না।’ তারপরেও বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর উপমা একমাত্র তিনিই। বাংলা ভাষায় তিনি সরস-মার্জিত-বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্যধারার প্রবর্তক। ব্যঙ্গ ও রঙ্গ-রসিকতায় তার রচনা প্রদীপ্ত। ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস, সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীল প্রবন্ধ মিলিয়ে তার বিপুল সংখ্যক রচনায় পান্ডিত্য ও সৃজন-সামর্থের বিচিত্র অভিব্যক্তি লক্ষণীয়। অন্তত দশটি ভাষায় দক্ষতা অর্জনকারি এই বিরল-প্রতিভা ভাষাতত্ত্ব ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পান্ডিত্যের পরিচয় রেখে গেছেন। তিনি জীবনের করুণ দিকগুলো সুস্পষ্টভাবে জানতেন বলেই জীবনের হাস্যরসের দিকগুলো নিপুনভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখনিতে হাস্যরসগুলো বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। বাস্তবকে ধরে সত্য উন্মোচনে তিনি হাস্যরসের রম্য রচনা সৃষ্টি করেছেন। মূলত, জীবনের গভীরতর ভেতর থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষেণের অর্ন্তদৃষ্টি ছিল বলেই তাঁর পরিবেশিত হাস্যরসের মধ্যে পরিমিত জীবনময়তা ছিল। জীবনের বেদনাক্লিষ্ট এবং করুণতম অভিজ্ঞতাকে মুজতবা সংবেদনশীলতার প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন বলেই বাংলা হাস্যরস সাহিত্যে তাঁর অবস্থান শাশ্বত। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততোদিন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যদিয়ে পাঠকদের কাছে বেঁচে থাকবেন।
(তথ্যসূত্র:
১- মুজতবা: সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য রচনাশৈলী, নুরুর রহমান খান, কথাপ্রকাশ (২০১০)।
২- গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র (২০১৫)।
৩- সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলি (১-১১ খন্ড), বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র (২০১৫)।
৪- কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর (দুই খণ্ড), সবিতেন্দ্রনাথ রায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৫- চরণ ছুঁয়ে যাই, শংকর, দে’জ পাবলিশিং (২০১৪)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে ও ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত