বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে এই অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করার কথা রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর। তিনিও এদিন অনুপস্থিত রইলেন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও আচার্যের উপস্থিতি ছাড়াই তা অনুষ্ঠিত হল নন্দনে। প্রতি বছর প্রেসিডেন্সির সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ডিরোজিও হলে। কিন্তু হোস্টেলের দাবিতে চলা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের জেরে এ বছর সমাবর্তন হল নন্দনে। যে কারণে সমালোচিত হতে হল আন্দোলনরত পড়ুয়াদের। ছাত্রদের আলোচোনায় বসা উচিত বলে মন্তব্য করেন খোদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে কীসের আন্দোলন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহা। এমনকি গোটা ঘটনার দায় যে পড়ুয়াদেরই, তাও সর্বসমক্ষে আনেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া।
বহুদিন ধরে চলা হিন্দু হোস্টেল নিয়ে পড়ুয়াদের আন্দোলন সোমবার এমন আকার নেয় যে, মঙ্গলবার বাধ্য হয়ে নন্দন- ৩ প্রেক্ষাগৃহে সমাবর্তন হয়। যা নজিরবিহীন। ছোট্ট একটি হলঘর। সাউন্ড সিস্টেম এমনই যে, সকলের বক্তব্যও সুস্পষ্ট ভাবে শোনার উপায় নেই। রয়েছেন কয়েক জন শিক্ষক আর শিক্ষাকর্মী। সেখানেই সাম্মানিক ডিএসসি দেওয়া হল ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত, ৭৯টি সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী সিএনআর রাওকে। সাম্মানিক ডিলিট পেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিৎ রায়ের আমল থেকে বাংলা সিনেমার দর্শককে একের পর এক ভাল ছবির উপহার দিয়ে আসছেন সৌমিত্রবাবু। প্রেমিকের চরিত্রে যেমন তিনি সফল, তেমনই সফল দুঁদে গোয়েন্দার চরিত্রেও। আবার ‘চারুলতা’- র অমলের সঙ্গেও কোথাও মিল নেই ‘হীরক রাজার দেশে’-র উদয়ন পণ্ডিত চরিত্রের। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অশনি সংকেত’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’- র মত ছবিতে তাঁর অভিনয় মনে দাগ কেটে গেছে। সেই সত্যজিতের নামাঙ্কন করা নন্দন- এ পুরস্কার নিলেন সৌমিত্র। কোথাও যেন জুড়ে গেল ‘অপুর সংসার’।
আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী না-থাকায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন উপাচার্য। তিনিই দুই অতিথিকে সম্মান জানান। ‘অপুর সংসার’ ছবির প্রসঙ্গ টেনে সৌমিত্রবাবুর অভিনয়ের প্রশংসা করেন তিনি। তার পরে সোজা ঢুকে পড়েন হিন্দু হস্টেলের প্রসঙ্গে। উপাচার্য জানান, হিন্দু হোস্টেল ১৩০ বছরের পুরনো। উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর কাছে হোস্টেল মেরামতির দাবি তুলছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। তারপরেই হোস্টেল সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা করতে সময় লাগছে। কারণ আমাদের হাতে কোনও জাদুদণ্ড নেই যে, ঘোরালেই হয়ে যাবে! এখন সংস্কারের কাজ করছে পূর্ত দফতর। বিরক্তির সুরেই অনুরাধাদেবী বলেন, ‘পড়ুয়ারা হিন্দু হোস্টেলে থাকতে আসেনি। প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসেছে। হোস্টেল হল একটা সুবিধা, যেটা তারা অধিকারের দ্বারা অর্জন করেনি। এটা দেওয়া হয়। এটা আবশ্যিকও নয়। তা সত্ত্বেও তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ওই বিশেষ ভবনটিই চাই এবং তা এখনই চাই। এটা কি যুক্তিসঙ্গত? কেন পড়ুয়ারা এত মরিয়া?’ হুঁশিয়ারির ঢঙে উপাচার্য বলেন, ‘‘কেউ ওদের ‘মিসগাইড’ করবেন না এভাবে। তা হলে কিন্তু এতোগুলো ছাত্রছাত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তাদের নিজেদের দোষেই।’’
গোটা ঘটনায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেই মুখ খুলেছেন সমাবর্তনে উপস্থিত বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ। তিনি বলেন, ‘আমার তো সন্দেহ হয়, এর পিছনে অন্য কোনও ফোর্স রয়েছে। আমি একদম নিশ্চিত। তালা দিয়ে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে? পড়াশোনা না-হলে, চাকরি না-পেলে কী করবে? দাদাগিরি করবে? পড়ুয়ারা ভাবে, আন্দোলন না-করলে বুঝি জাতে ওঠা যায় না! রাজনীতি আমরাও করেছি। কিন্তু তার মধ্যে নৈতিকতা ছিল। জনগণের সম্পত্তিতে তালা লাগিয়ে দেবে?’ ঐতিহ্য মেনে সমাবর্তন হতে না-পারাটা যে তার ঐতিহাসিক গৌরবের সঙ্গে মেলে না, সেটা বোঝাতে চেয়েছেন সাম্মানিক ডিএসসি প্রাপক সিএনআর রাও। তিনি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্সির ইতিহাসের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। দুর্ভাগ্যবশত বাংলার মানুষের মধ্যে নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’’ তাঁর মতে, প্রেসিডেন্সি দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পড়ুয়ারাও তার অংশ। ফলে বিক্ষোভ না করে বোঝাপড়ার জায়গায় আসা উচিত। ‘আমরা সকলেই বড় কিছু পাওয়ার জন্য ছোট জিনিসকে ত্যাগ করি। এটা সকলের মাথায় রাখা উচিত’, বলেন রাও। আর সাম্মানিক ডিলিট প্রাপক সৌমিত্রবাবু বলেন, ‘এটা কর্তৃপক্ষ আর পড়ুয়াদের ব্যাপার। তাঁদেরই মিটিয়ে ফেলা উচিত।’