না! অসমের সবাই অহমিয়া না। ওর পরে যে যে রাজ্য আছে, সেখানে সব্বাই ছোট চোখের না। চাইনিজদের মতো ও সব্বাই দেখতে লাগে না। সব্বার রাজধানী শিলং নয়। যেমন দক্ষিণ ভারতের সব্বাই মাদ্রাজি নয় আর তাদের সব্বার গায়ের রঙ কালো নয়৷
ভারতের সব এংলো ইন্ডিয়ানের কপালে কিন্তু সকালে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট জোটে না। সব পারসী মানেই এডুলজী-টাটার মতো ধনী নয়। চায়না টাউনের অনেক বাসিন্দাই কিন্তু বাংলায় কথা বলতে পারে আর তারা সবাই মোটেও সাপ ব্যাঙ ফ্রাই খায় না৷
মুসলিম বাড়িতে রোজ রাতে গরুর মাংস রান্না হয় না। তারা সবাই লম্বা দাড়ি রাখে না। অনেকেই লুঙ্গি পড়ে না। সবার পাঁচটা করে বাচ্চা হয়না৷
দিল্লি মানেই কথায় কথায় রাস্তাঘাটে রেপ হয়না৷ মুম্বাই মানেই সবাই কোটি টাকার চাকরি করেনা। বিহারী মানেই আকাশ বাতাস জুরে সবাই গুটখার পিক ফেলে না, ফুচকা বেচে না, টানা রিক্সা চালায় না৷ ভারতের বেশীর ভাগ আমলা বিহারের।
সব কাশ্মীরি কিন্তু পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে না। সবাই জোব্বা পড়ে না৷ সব্বার কাঠের বাড়ি নেই৷ সব্বার ঘরে পেস্তা বাদাম রোজ রাখা থাকেনা। অনেকেই রোজ স্নান করে৷
ভারতবর্ষ। ১২,৬৯,৩৪৬ বর্গ মাইলের এক ভূখন্ড। এখানে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশেরা দেশ ছেড়ে পালায়, মহাম্মদ জিন্না নিজের কিছু মুসুলমান ভাইবোনকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যায় আর ভারতের বাকি সবাই সাদা পাঞ্জাবি আর গান্ধী টুপি পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দে উদ্বাহু নেত্ত করতে শুরু করে। অবশ্যই হিন্দিতে।
এরা র্যাডক্লিফ লাইন, ১৯৭১ এর ইতিহাস, দেশভাগের ক্ষত, পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব, নোয়াখালীর দাঙ্গা, AFSPA, কাশ্মীরের প্লেবিসাইটের দাবী জানে না। জানতে ও চায়না। জন্মসূত্রে এরা স্বাধীন বা সিনেমাসূত্রে জেপি দত্ত, সানি দেওল আর মনোজ কুমারের ফ্যান। ওটাই ওদের ভারতবর্ষ।
এখানে যেকোন ভারতীয়কে জিজ্ঞেস করুন, ভগৎ সিং সম্বন্ধে। বলবে গোঁফ, হ্যাট তরুন শহীদ হয়েছিল, পাঞ্জাবের কোথাও একটা ফাঁসিকাঠে গেছিল৷ জিজ্ঞেস করুন হুসেইনিওয়ালা গ্রাম কি কারনে ওর সাথে জুরে আছে? স্তব্ধতা শুনবেন।
এখানে যেকোন ভারতীয়কে জিজ্ঞেস করুন, আইএনএ কি এবং কোন যুদ্ধ লড়েছিল তারা? দিল্লি হলে শুনবেন, আইএনএ (মার্কেট) তে ভালো মোমো পাওয়া যায়। বাকি জায়গায় এনআইএ এর সাথে গুলিয়ে ফেলবে৷ এই রাষ্ট্রের কথাই বলছি৷
Nation State বড় কঠিন শব্দ। গভীর শব্দ। মায়ামমতাহীন দৃঢ় শব্দ। এই যে এত্ত বড় একটা দেশ দিব্বি চলছে, এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নত হচ্ছে- এটা কি কেবল আপনি একদিন ভোট দিচ্ছেন বলে? বা ট্যাক্স ঠিক সময় দেন বলে? বা সরকার কে সমর্থন করে ভারত মাতা কি জয় বলেন বা পাকিস্তানকে ঘেন্না করেন বলে?
ভারতবর্ষ নামক যে রাষ্ট্র অক্ষত আছে, সেটা কেবল মেরুদন্ড সোজা করে জাতীয় গান গাওয়ার জন্য না। এটা অক্ষত ক্ষেতে কিষাণ, কলে মজুর কাজ করছে বলে। ডাক্তার ডাক্তারি করছে বলে, সাংবাদিক লিখছে বলে। নেতা ভাষণ ঝাড়ছে বলে ও। এই প্রকান্ড যন্ত্র সচল রাখতে কিছু স্বার্থহীন পেশাদার দিনরাত কাজ করে যায়। তার বিনিময় বেতন পায়। এদের নামে জয়ধ্বনি হয় না কারণ আন্তঃরাষ্ট্রীয় খাতায় কলমে এদের কোন উল্লেখ থাকেনা। মৃত্যু হলে পরমবীর চক্র পায় না রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে।
এই যে বিশাল রাষ্ট্র ৭২ বছর বয়সী তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জুরে যে একটা ডোকলাম আছে, একটা কালাহান্ডি আছে, একটা তুতিকোরিন আছে, একটা তেভাগার প্রতিরোধ আছে সেটা এই রাষ্ট্রই বহন করে চলবে৷ এদের গোবলয় মেনে নিক বা না নিক। এদের এনআরসিতে নাম থাকুক বা না থাকুক। এরা ছিনে জোঁকের মতো এই রাষ্ট্র কাঠামোর গায়েই সেঁটে থাকবে। উত্তর ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে ভারতীয় হিসেবে সমানাধিকার নিতে।
স্বাধীনতার ৭২ বছর বাদে আমি সেই ভারতে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে আজ ও হিন্দু মুসলিমের নামে খুনোখুনি হয়, পোঁড়া মাংসের গন্ধ বেরোয় নববধূর শশুড়বাড়ি থেকে ৷ আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই বৈজ্ঞানিক সন্ধিক্ষণে যেখানে গোমূত্র ক্যান্সার প্রতিরোধক হতে পারে। আমরা বোধহয় সত্যি দাঁড়িয়ে পরেছি উন্নতির ম্যারাথনে।
১২,৬৯,৩৪৬ বর্গ মাইলের এক ভূখন্ডের নাম ভারতবর্ষ। এখানে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে ভারত বলতে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান, জাতীয় ভাষা বলতে হিন্দি আর জাতীয় সংগীত বলতে জন গন মন। ওদের কে বোঝাবে ওটা উচ্চারিত হয় ‘জনো গনো মনো’।
এই স্বাধীনতার বার্ষিক উদযাপনে আসুন পুরোনো ধারণা পাল্টাই৷ স্টিরিয়োটাইপ বদলাই৷ পরশীকে চিনি আসুন। ওরাও আমার আপনার মতোই একশো পঁচিশ কোটি।
কালাহান্ডি, তাওয়াং, বুদগাম, কন্যাকুমারী, উখরুল, ছিটমহল এ আনা যায় না গোটা রাষ্ট্রকে? কেন প্রতি বছর ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে কিছু খুচরো প্রতিনিধি নাচবে-কুদবে, প্রবল দেশোদ্ধার করতে টেম্পো সাজাবে ইন্ডিয়া গেটের সামনে?
যে বামুনের ছেলে দুবেলা ভাত খেতে পারেনা, শ্রমের বিনিময়ে খিস্তি খায় বিপিএল কার্ড চেয়ে, তাকে ও দলিত আখ্যা দেওয়া যায় না?
যে তপশীলি ছেলেটির বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বড় চাকরি করে,সরকারি আবাসনে থাকে, তার সব সুযোগ সুবিধা দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করা যায় না?
রোদ-জল-বন্যা তে দু মুঠো চালের খোঁজে লড়াই করা “প্রজাতন্ত্র থেকে কিচ্ছু টি না পাওয়া” সমস্ত পদ-দলিতই তো প্রজাতন্ত্র। কাঁটাতার এর কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোই তো বোঝে কাঁটাতারের ক্ষত। তাদের যদি দেশ এর বুকে নিয়ে আসা না হয়,ক্ষততে সাময়িক মলম না পরে, কি করে দেশত্ববোধ জাগবে প্রান্তিক হৃদয়ে?
আসলে সময়টাই বোধহয় গোলমেলে। বহুত্ববাদ খায় না মাথায় দেয়, তা গুলিয়ে দেওয়ার খেলা চলছে। কে কত দাঁত খিঁচিয়ে, চোখ রাঙিয়ে দেশবাসী কে বোঝাতে পারবে এক দেশ এ একই নিয়ম, একই ভাষার ব্যাবহার, একই বিশ্বাস।
শেষ পাতে থেকে যাচ্ছে কিচ্ছুটি না পাওয়া প্রজা, ওই হাসপাতালে বেড পেতে মারপিট করা মানুষগুলোর মত। মূল ভূখন্ড থেকে অনেক দূরে টিভি তে চোখ রেখে আপ্প্রান ভারতীয় হওয়ার চেষ্টায় থাকা সংখ্যালঘুর মত।
বিউগল বাজবে, সন্ধ্যে নামবে, পতাকা যত্ন করে ভাঁজ করে নামিয়ে নেওয়া হবে। আম আদমি এবার রাতের খাবার খাবে। ভাত,ডাল, কাঁচা লংকা আর শেষ পাতে দিনবদলের স্বপ্ন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )