একসময় বাম ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হওয়ার সুবাদে ঋতব্রত’র রাজনৈতিক উত্থান কিছুটা হলেও আমি জানি । এত কম বয়সে এমন একজন বিচক্ষণ নেতাকে নিজেদের চেয়ার খোয়ানোর ভয়ে অনেক বড় বড় সিপিএম নেতা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। রাগটা তখন থেকেই । ঋতব্রত’র দামি পেন আর ঘড়ি নিয়ে সিপিএমের সেই সব নেতারাই সরব হল। যদিও এরা প্রায় সবাই অ্যাপেল এর ফোন , আইপ্যাড ব্যবহার করেন। শুধু ঋতব্রত’র বেলায় তখন তাদের মনে পরে গেছিল সিপিএম সর্বহারাদের পার্টি । ঘড়ি আর পেন নিয়ে বেশী কিছু করা যখন যাচ্ছিল না তখন তার ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে এনে চরিত্রহীন আখ্যা দেওয়া হল। আচ্ছা ধরে নিলাম ঋতব্রত চরিত্রহীন। সিপিএমের বাকি সবাই নিজেদের চরিত্র নিয়ে ওয়াকিবহাল কী? হঠাৎ করে সিপিএমের কিছু নেতা ঋতব্রতর চরিত্র কে সামনে আনার জন্য উঠে পরে লাগল কেন বলবেন কমরেড ? দল থেকে বহিষ্কার এর পর মূল সত্যটা তো আরও বেশি করে তুলে ধরা উচিত ছিল তাই না? সেটা তারা করলেন না কেন? আসলে চেয়ার আগলে রাখা কিছু সিপিএম নেতার মূল উদ্দেশ্যই তো ছিল যেভাবেই হোক ঋতব্রত কে দল থেকে তাড়ানো। সেটাতে তো সফল। আর কি দরকার। তাদের চেয়ারটা তো বেঁচে গেল। চকচকে দড়ি ঝোলানো দামি চশমা পরা সিপিএমের নেতাটির কথা মনে পড়ে কমরেড ? তার চশমার বিলটা মনে পড়ে ? সেটা ছিল সরকারের টাকায়। সর্বহারা সিপিএম দলের সেই নেতা ৫৫৫ ও অন্যান্য দামি ব্র্যান্ড ছাড়া নাকি খেতেই পারতেন না। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কি হয়েছিল কমরেড ?
ঋতব্রতকে টার্গেট করা ‘সংখ্যালঘু কোটার নেতার নাকি পরীক্ষা দেওয়ার সময় পেন বা ঘড়িও থাকতো না। তা নির্বাচনী হলফনামায় তার কোটি টাকার হিসেবের উৎস কি? পার্টির হোলটাইমার। অথচ বার্ষিক রোজগার ৬ লাখ। মানে মাসে ৫০ হাজার। সিপিএম হোলেটাইমারদের ৫০ হাজার করে ভাতা দেয় নাকি? ১২০০ ভোটে জেতা সাংসদ যদি জানান তাহলে ভালো হয়। আসলে সংসদে ঋতব্রতর পারফরম্যান্সই ঋতব্রতর বিপদ ডেকে এনেছে। বাংলার ‘স্বঘোষিত’ নেতাকে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দেবে নতুন সাংসদ। এসব মানা যায় নাকি?
চশমা ঝোলানো ‘তাত্ত্বিক’ আর ১২০০ ভোটে জেতা সাংসদের বক্তৃতার বাজারও ঋতব্রত মেরে দিচ্ছিল। জেলায় জেলায় তাদের বদলে ডাক পাচ্ছিল ঋতব্রত। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঋতব্রতকে কোতল হতেই হতো। এটাই সিপিএমের দস্তুর। হলোও তাই।
ঋতব্রত নিজের উপার্জন করা টাকায় জিনিস কিনে ব্যবহার করেছেন। তাহলে ওর বিরুদ্ধে এমন আচরন কেন? আর ঋতব্রতর বিরুদ্ধে তদন্তের মূল দায়িত্ব কাকে দেওয়া হল সেটাও তো জানেন কমরেড । সেই সাংসদ হঠাৎই উৎসাহিত হলেন কেন জানেন কমরেড , নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে। এমনিতেই ঋতব্রত তাকে সংসদ কক্ষে যুক্তিপূর্ন কথা বলে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এটা কি ভাবে মানবেন তিনি যে একটা ৩৮ বছরের ছেলে তার থেকে এগিয়ে যাবে । সিপিএম দলে এটা কোনদিন হয়নি। তাই নিজের চেয়ার সুরক্ষিত রাখতে ঋতব্রত কে তাড়ানোর এই সুযোগটা হারাতে চাইলেন না । শুধু সংসদ কক্ষ কেন ঋতব্রত দলে থাকায় পশ্চিমবঙ্গ তেও তার বক্তা হিসেবে অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসেছিল । ঋতব্রত কে দল থেকে তাড়ানোর শিলমোহর দিয়ে সেই জায়গাটা সুরক্ষিত করে নিলেন। এই আচরন যাদের তাদেরকে কী বামপন্থী আখ্যা দেওয়া যায়? সেটাই জানতে ইচ্ছে করে ।
ঋতব্রতর সঙ্গে শুরু থেকেই রাস্তায় নেমে রাজনীতি টা করেছি। এটুকু বুঝেছিলাম ও এসি ঘরে চেয়ারে বসে থাকা বাম নেতা নয়। ও ছিল প্রকৃত বামপন্থী। বামপন্থী মানেই সিপিএম নয়। বামপন্থার জাগির শুধু সিপিএমের হাতে নেই। বামপন্থী হতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। ঋতব্রত ঠান্ডা ঘরের নেতা কখনই হতে চায়নি। প্রকৃত বামপন্থী রা মানুষের জন্য কাজ করে । চেয়ার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এসি ঘরের মধ্যে থেকে চেয়ার আগলে যারা বসে থাকে তারা সিপিএম নেতা হতে পারে কিন্তু বামপন্থী নয়। আর সত্যি তো ঋতব্রত সিপিএমের জন্য কি করেছে ? এসি ঘরে চেয়ার আগলে বসে থাকতে হত তাহলেই প্রকৃত পার্টি দরদী নেতা হত। তা তো করতে পারেনি । ও কি করতে গেল ? আগবাড়িয়ে এসি ঘরে থাকা নেতাদের টপকে রাজ্যসভার সংসদে পশ্চিমবঙ্গ কে প্রাধান্য দিয়ে , বাংলাকে বঞ্চনার প্রতিবাদ করে সেরা সাংসদ হয়ে গেল। ওটাই ঋতর কাল হল,তখন থেকেই শুরু হল দল থেকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া। চেয়ার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে একজোট হল সেই সব নেতারা যারা সিপিএম কিন্তু বামপন্থী নয়। কেননা এরা বাংলার বঞ্চনার কথা কখনই তুলে ধরবে না। তুলে ধরবে না বললে ভুল বলা হবে এই সব কথা তুলে ধরার যোগ্যতাই তাদের নেই। তারা জানে শুধু চেয়ার আগলাতে। ঋতব্রত সত্যিকারের বামপন্থী। ও কখনই সিপিএম নেতা ছিল না। আর তাই মানুষের জন্য আরও কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই প্রকৃত বামপন্থী মমতা ব্যানার্জির হাত ধরে ঠিক কাজ করেছে ।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
(লেখক কলকাতার বাম ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন কর্মী)