“ঝাপসা অতীত, ক্লান্ত পথিক, খুঁজে ফিরি ঘর আমার”- প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরানোর সময় গানের এই লাইনটিই বারবার শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়ছিল কানের কাছে। সৌজন্যে পরিচালক দ্বয় সুদেষ্ণা গুহ এবং অভিজিৎ রায়ের নতুন ছবি ‘শ্রাবণের ধারা’। সম্প্রতি যা দেখান হল ২৫ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এশিয়ান সিলেক্ট (নেটপ্যাক) বিভাগে।
অমিতাভ সরকার ও নীলাভ রায়। একজন জীবনের অর্ধেকের বেশিটা পথই পেরিয়ে এসেছেন। আর অন্যজন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের লক্ষ্যের দিকে। বয়সে প্রবীণ অমিতাভ অ্যালজাইমার্স-এ আক্রান্ত হয়ে বর্তমান ভুলে গিয়েছে। তাঁর কাছে তাই ‘ঝাপসা’ অতীতটাই বেশি স্পষ্ট। আবার পেশায় ডাক্তার নীলাভ নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে অস্বীকার করতে চান অতীতকে। জীবন থেকে অতীতকে পুরোপুরি মুছে ফেলে বাস্তব আর ভবিষ্যৎ নিয়ে এগোতে চান তিনি। মূলত এই দুটি চরিত্র এবং তাদের অতীতের ওপর ভর করেই এগোতে থাকে অভিজিৎ-সুদেষ্ণার ছবি।
তবে এর পাশাপাশি গল্পে অনেকটা জায়গা নিয়ে রয়েছেন এক নারীও। শুভা সরকার। যিনি অমিতাভর স্ত্রী। অমিতাভ-শুভার অসম বয়সী সম্পর্ক। বিশ্বভারতীতে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে প্রেম, বিয়ে- অমিতাভর চিকিৎসার স্বার্থে সবটাই তিনি একে একে জানাতে থাকেন তাঁর চিকিৎসক নীলাভর কাছে। কিন্তু হঠাতই একদিন খটকা লাগে নীলাভর। তাঁর মনে হয়, তাঁদের অতীত নিয়ে কোনও একটা কথা যেন আড়াল করতে চাইছেন অমিতাভর চেয়ে কমপক্ষে বছর চল্লিশের ছোট শুভাদেবী। এরপর কী হয়, তার জন্য অবশ্যই দেখতে হবে ছবিটি।
ছবিতে অমিতাভর চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিজের অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতার গুণে কবিতা পাগল, অ্যালজাইমার্সে ভোগা অমিতাভ চরিত্রটিকে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন তিনি। তাঁর সংলাপ বলার ধরণ, স্মৃতি হাতরানোর ছোট ছোট অভিব্যক্তিগুলিকেও বড় জীবন্ত মনে হয়েছে। ভাল চিত্রনাট্য এবং চরিত্র পেলে আজও যে তিনি কতখানি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, ‘বেলাশেষে’, ‘ময়ূরাক্ষী’র পাশাপাশি ‘শ্রাবণের ধারা’ ছবিটিও তার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
নীলাভর চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ও বেশ মানানসই। একদিকে জীবনে সফল হওয়ার লক্ষ্যে ইঁদুর দৌড়ে সামিল হওয়া এক উচ্চাকাঙ্খী ডাক্তার, আর অন্যদিকে, এমন একটি মানুষ, যে কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও বাবা। এই দুইয়ের মাঝে পড়ে নীলাভর মধ্যে যে টানাপোড়েন চলতে থাকে সর্বক্ষণ, পরমের অভিনয়ের গুণে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ভাল লাগে শুভার চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরি এবং নীলাভর স্ত্রী এবং বন্ধুর চরিত্রে বাসবদত্তা এবং পদ্মনাভ দাশগুপ্তের অভিনয়ও। বলতে গেলে অভিনয় এই ছবির সম্পদ।
নিউ জার্সিতে থাকা ডাক্তার শুভেন্দু সেনের লেখা ‘বিটুইন রেনড্রপ’ গল্প থেকেই এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় গল্প ভাল হলেও দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে মাটি হয়ে যায় গোটা ছবি। তবে এক্ষেত্রে পদ্মনাভর চিত্রনাট্যের বাঁধুনি ছিল বেশ আঁটোসাঁটো। গলদ নেই অভিজিৎ-সুদেষ্ণার পরিচালনাতেও। কীভাবে এ যুগের ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে আশির দশকের মূল্যবোধ হারিয়ে যায়, আর কীভাবেই বা একটা সময়ের পর তারা ঘরে ফেরার টান অনুভব করে, চড়া মেলোড্রামার আশ্রয় না নিয়েও পর্দায় তা খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁরা। আর তাতে বিন্দুমাত্রও মেদ জমতে দেয়নি সুজয় দত্তরায়ের সম্পাদনা।
“শ্রাবণের ধারা” বললেই রবি ঠাকুরের যে গানের কথা মাথায় আসে, জয়তী চক্রবর্তীর কন্ঠে সেই গানটিই ছবির টাইটেল ট্র্যাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া সঙ্গীত পরিচালক দ্বয় আশু-অভিষেকের সুর ও গীতিকার দূর্বা সেনের কথায় ছবির সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গিয়েছে “অস্থির সময়” গানটি। এই মুহুর্তে বাংলা গানের জগতে গীতিকারের সংখ্যা নেহাতই হাতেগোনা। আর মহিলা গীতিকার নেই বললেই চলে। সেখানে দূর্বা সেনের কলম নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন “অস্থির সময়” গানটি দিয়ে। তিনি লিখছেন, “অস্থির সময়, কঠিন অসুখ, লুকিয়ে কোথায় শিকড় আমার/ ঝাপসা অতীত, ক্লান্ত পথিক, খুঁজে ফিরি ঘর আমার।”
সত্যিই তো এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের অতীত, নিজের শিকড়কে আঁকড়ে ধরতে চান অমিতাভ। এবং ছেলেবেলার বন্ধু বা অন্য আর পাঁচটা মানুষের মতোই শেষমেশ বাবা-মা, স্ত্রী, কন্যার কন্ঠস্বরে গমগম করতে থাকা একটা ঘর খুঁজে ফেরেন নীলাভও। আর তাই একাধিকবার ছবিতে ফিরে ফিরে আসে রূপঙ্কর ও ইমনের কন্ঠে “ঝাপসা অতীত, ক্লান্ত পথিক, খুঁজে ফিরি ঘর আমার”। কিন্তু এত ভাল কিছুর মধ্যেও খারাপ লাগে ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি। প্রভাতেন্দু মণ্ডলের ক্যামেরায় নতুন কিছুই ধরা দেয়নি। ছবিটির ‘সেকেলে’ কালারটোন প্রভাত রায় বা তরুণ মজুমদারদের …