একদা ‘গড়’ বলে পরিচিত বাংলা থেকে নারী ও শিশু পাচারের হার একধাক্কায় কমল প্রায় ৯০ শতাংশ।। এই মানবপাচার যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে এরাজ্য বা ভিনরাজ্য থেকে উদ্ধারের ঘটনাও। এই বৃদ্ধির হার প্রায় দু’গুণ। একইসঙ্গে বেড়েছে পাচারে যুক্ত দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার এবং মামলা শেষ হওয়ার সংখ্যাও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে বাংলার এই সাফল্যের কাহিনী।
ইউনিসেফ, মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক এবং মানবপাচার রোধে কাজ করা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবর্তিত দুই প্রকল্প – স্বয়ংসিদ্ধা এবং কন্যাশ্রী। নারী সশক্তিকরণের ক্ষেত্রে মাইলস্টোন হওয়া এই দুই প্রকল্প রোধ করেছে মানবপাচার। এনসিআরবি’র এই রিপোর্ট সামনে আসার পর স্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পুলিস, সিআইডি, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের পড়ুয়া-সহ সমস্ত পক্ষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘মানবপাচারে শুধু একটা পরিবার নয়, গোটা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশাসনিক সমস্ত স্তরে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পাচারের সমস্ত চক্রকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য।’ পাচারের সংখ্যা কমায় সাধারণ মানুষকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘লাগাতার প্রচার চলছে অবশ্যই, পাশাপাশি মানুষও সচেতন হয়েছেন।’
এনসিআরবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গোটা দেশে নারী পাচারের ২৫ শতাংশের ভাগীদার ছিল বাংলা। মানবপাচারের ক্ষেত্রে গোটা দেশের মধ্যে এই রাজ্যের শেয়ার ছিল ৪৪ শতাংশ। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, এমন একটা পরিস্থিতিতে মানবপাচার রুখতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পিত পথে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় রাজ্য পুলিস চালু করেছিল ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ প্রকল্প। পাচাররোধে সচেতনতা বাড়ানো, স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে মারাত্মক বিপদ সম্পর্কে উপলব্ধি বৃদ্ধি, কুপ্রথা ও বাল্যবিবাহ রোধে এনজিও, সিআইডি’র মতো তদন্ত সংস্থা, বিএসএফ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে লাগাতার প্রচার এই সবই ছিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। মানবপাচার রোধে শক্তপোক্ত নীতি রূপায়ণের লক্ষ্যে তৈরি হয় ‘স্টেট প্ল্যান অব অ্যাকশন টু কমব্যাট অ্যান্ড প্রিভেন্ট ট্রাফিকিং’ সংক্ষেপে এসপিএএইচটি। পাশাপাশি নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজাকে মাথায় রেখে রাজ্য স্তরে একটি কমিটি গঠন করা হয়। একইভাবে বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য সচিব পর্যায়ের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ঘনঘন বৈঠকে বসে এই দুই কমিটি মানবপাচার রোধে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তার পর্যালোচনা করে।
নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বয়ংসিদ্ধাকে সাফল্যের মুখ দেখাতে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে কন্যাশ্রী। এতে একদিকে যেমন স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে, তেমনই আবার সবুজসাথী, খাদ্যসাথীর মতো নানা সরকারি প্রকল্প পডুয়াদের মূল স্রোতে থাকতে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। আর তার জেরেই কমেছে নারী ও শিশু পাচার। গত ২০১৬ সালের এনসিআরবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্য থেকে পাচার হয়েছিল মোট ৩,৫৭৯ জন। ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৫৭। এর পরের বছরের (২০১৮) রিপোর্ট এনসিআরবি এখনও প্রকাশ না করলেও, জানা গিয়েছে পাচার সংখ্যা কমার ধারা অব্যাহত রয়েছে।