‘ব্যাটারা এবার টের পাবে!’- কান পাতলে ইদানীং ঠিক এই সুরেই ভেসে আসছে বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে টাইট দেওয়ার কথা। নিজেদের মতো করে এনআরসির ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন অনেকে। সঙ্গে আবার বলা হচ্ছে হিন্দুদের জন্য বিশেষ রক্ষাকবচের কথাও। কিন্তু আদৌ কি হিন্দুরা কোনও বিশেষ রক্ষাকবচ পাচ্ছেন? উত্তরটা না। এমনকী তিনি সরকারি চাকুরিজীবী হলেও না।
১৯৫০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিলচর নারীশিক্ষা আশ্রম নামে একটি নার্সিং হোমে জন্মগ্রহণ করেন বিনয়েন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর বাবা প্রয়াত যাদবেন্দ্র ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা কমলাদেবী (৯১) এখনও বেঁচে। ১৯৭০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন বিনয়েন্দ্র। ১৯৭৫ সালে অসম সরকারের জলসেচ দফতরে চাকরিও পেয়ে যান। ২০১০-এ ৩৫ বছর চাকরি করার পর অবসর। সমস্ত কাগজপত্রই তাঁর কাছে রয়েছে। ১৯৫৯ সালের ভোটার তালিকাতেও তাঁর মা-বাবার নাম ছিল। সেই প্রমাণও জোগাড় করেছেন।
কিন্তু এতকিছুর পরেও তাঁর নাম নেই! নাম বাদ গেছে তাঁর দুই ছেলেরও। তাঁকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে নিজের নাগরিকত্ব। এর আগে ৪ ভাই ও ৪ বোনকে গুয়াহাটি নিয়ে গিয়ে একবার বংশবৃক্ষের প্রমাণ দিয়ে এসেছেন। হয়নি। এত বছর সরকারি চাকরি করেও তাঁর নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নের সামনে। কারণ হিসেবে তাঁকে বলা হয়, অন্য কেউ তাঁর বংশবৃক্ষ ব্যবহার করে নাগরিকত্ব দাবি করেছেন।
তাঁর বংশবৃক্ষে, মানে জ্ঞাতিগুষ্টির নামে সব মিললেও, পিসির নাম নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তাঁর পিসির নাম কনকলতা। কিন্তু অন্য একজন নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে বিনয়েন্দ্রর বংশবৃক্ষে কনকলতাকে হেমলতা নামে ব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তার পরও নাম ওঠেনি বিনয়েন্দ্রর।
গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী জানিয়েছেন, তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যাবেন না। সরাসরি হাইকোর্টে মামলা করবেন। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টেও যাবেন। তবে এর শেষ দেখে ছাড়বেন। তাঁর উপলব্ধি, এনআরসি করাই হয়েছে বাঙালিদের হয়রানি করতে। এনআরসি হলে বাংলার সর্বনাশ হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে বিনয়েন্দ্র উদাহরণ মাত্র। এনআরসি তালিকায় সমস্ত প্রমাণ হাতে নিয়েও নাম তুলতে পারেননি ১৯ লাখের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ। এমনটাই মনে করেন আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতির কিশোর ভট্টাচার্য। বন্দীশালায় আটক হয়ে রয়েছেন বহু বৈধ ভারতীয়। টাকার অভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি। দু’বেলা ভাত জোটে না যে সব প্রান্তিক মানুষদের, তাঁদের পক্ষে আইন-আদালত করাটাই তো দুঃসাধ্য।
এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর এখনও নোটিস পাননি ১৯ লাখ মানুষ। নোটিস পেলেই ১২০ দিনের মধ্যে আরেক লড়াই। আইনি লড়াই জিততে না পারলেই আমৃত্যু কারাবাস। হ্যাঁ, আমৃত্যু। কারণ তিন বছর পর সাজার মেয়াদ শেষ হলেও, ২ লাখ টাকার জামানত লাগবে। লাগবে দু’জন জামিনদারও। গরিব মানুষের পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব।