দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাসখানেক আগেই আসামে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। যাতে দেখা গেছে, হিন্দুদের রক্ষাকবচ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিই সার। তালিকায় নাম না থাকা ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষই হিন্দু। এর ফলে ইতিমধ্যেই জোর প্রতিবাদ শুরু করেছে খোদ আসামের বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরাই। তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক। আসামের মতো বাংলাতেও এনআরসি শেষমেশ ব্যুমেরাং হয়ে গেরুয়া শিবিরের দিকেই ধেয়ে আসবে না তো! রাজ্য বিজেপির অন্দরে এখন এই আশঙ্কাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, যে উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালি ভোট ব্যাঙ্ককে হাতিয়ার করে বাংলায় তাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে চাইছে, এনআরসির আতঙ্কে সেই ভোট ব্যাঙ্কেই ফাটল ধরার ইঙ্গিত পাচ্ছে রাজ্য বিজেপির নেতারা।
এর অবশ্য কারণও রয়েছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এনআরসি আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন বেশ কয়েকজন। রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্বাস্তু হিন্দুদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তীব্র ভয়ভীতি বিজেপির নজর এড়িয়ে যায়নি। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথাতে তার ইঙ্গিতও স্পষ্ট। তিনি অবশ্য সব দায় শাসক দলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে ইচ্ছে করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তৃণমূল। রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষকে এনআরসি জুজু দেখানো হচ্ছে। আমরা তো কিছু বলছি না। আসল কারণটা হচ্ছে, গত লোকসভা ভোটে উদ্বাস্তু হিন্দুরা আমাদের ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতেই তৃণমূল এনআরসি আতঙ্ক তৈরি করছে ওদের মধ্যে।’
একই সুরে বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও মঙ্গলবার বুনিয়াদপুরে গিয়ে বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে তৃণমূল। নোটবন্দীর সময়েও একইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল ওরা।’ এখানেই শেষ নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে দলের উদ্বাস্তু সেলকে আসরে নামানোর কৌশল নিয়েছে গেরুয়া শিবির। আগামী ১ অক্টোবর কলকাতায় আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। রাজ্য বিজেপি চাইছে, অমিত এমন কিছু কলকাতায় এসে বলুন, যাতে এনআরসি নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি কিছুটা হলেও কমে। উদ্বাস্তু সেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনা, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দুই দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদের মতো জেলাগুলির কর্মীদের দিয়েই নেতাজি ইন্ডোরে শাহের কর্মীসভা ভরানোর।
তবে আপাতত এনআরসি ইস্যুতে রাজনৈতিক লড়াইয়ে তৃণমূল কয়েকশো যোজন এগিয়ে আছে ঘাসফুল শিবিরের থেকে। নিয়ম করে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় রোজই মুখ খুলে কাঠগড়ায় তুলছেন এনআরসিকে। সাফ জানাচ্ছেন, বাংলায় ওসব হবে না। অন্যদিকে, রাজ্য বিজেপি নেতারা এনআরসির পক্ষে সংগঠিত প্রচারই শুরু করতে পারেননি এখনও। উল্টে গোড়াতেই দিলীপ ঘোষরা যেভাবে ‘বাংলায় এনআরসি হবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন তা বিজেপির জন্য হিতে বিপরীতই হয়েছে। তাই বিজেপি এখন এই বার্তা দিতে মরিয়া যে বাংলায় এনআরসি হলে হিন্দুদের কোনও সমস্যা হবে না। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রভাব এখনও সেভাবে পড়েনি। বরং সীমান্তবর্তী এলাকায় এনআরসির আতঙ্ক আরও তীব্র ভাবে ছড়িয়েছে। তাই আসামের মতো বাংলাতেও যে এনআরসি শেষমেশ ব্যুমেরাং হতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা বিজেপির রাজ্যনেতাদের একাংশের।