ক্রমশই ছন্দে ফিরছেন, তা বোঝাই যাচ্ছিল। মেক্সিকোর বিপক্ষে তাই আশা ছিল। নেইমারকে যেভাবে দেখার প্রত্যাশা সেভাবে দেখা যাবে। ‘নুডলস’ চুল নয়, পলকা টোকায় গড়াগড়ি খাওয়া নয়, এমনকি বল নিয়ে অযথা ‘নাপিতগিরি’ করাও নয়। গোল করবেন নেইমার, যে গোলে থাকবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সৌরভ। সমর্থকদের এই আশাটা নেইমার পূরণ করলেন এত দিন পর!
গ্রুপ পর্বে নেইমারকে নিয়ে শুধু বিতর্কই উড়েছে। পায়ের চোট কাটিয়ে এসেছেন বিশ্বকাপে। কিন্তু তিতের মতে ‘শতভাগ সুস্থ ছিলেন না’। সমালোচকদের তাতে থোড়াই কেয়ার। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে যতটুকু খেলেছিলেন, তার চেয়ে মাটিতেই বেশি পড়েছেন! কোস্টারিকার জালে তাই গোল পেয়েও আলোচনায় ছিলেন সেই মাটিতে পড়ে যাওয়ার জন্য। সার্বিয়ার বিপক্ষে কিছুটা খোলতাই রূপে দেখা গেলেও সেটা যেন নব্বই দশকের টিভির মতো—এই ঝিরঝির তো এই ছবি!
শেষ পর্যন্ত নেইমারের প্রত্যাশিত ছবিটা বেশ পরিষ্কার হলো। সেটা ম্যাচের শুরু থেকেই। ৫ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে কিক নিয়ে গিয়ের্মো ওচোয়াকে গ্লাভস গরম করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এরপর মেক্সিকোর বক্সে কয়েকটি ইতিউতি আক্রমণের চেষ্টা। পাওলিনহো, উইলিয়ান আর জেসুসকে নিয়ে খেলা বানানোর চেষ্টা। কিন্তু ঠিক নিখুঁতভাবে কোনো কিছুই মিলছিল না। সাম্বার তাল উঠছিল ঠিকই কিন্তু শেষ অন্তরায় গিয়ে কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছিল। বিরতির পর এই পরিমার্জনাটুকু নিজেই করেছেন নেইমার। তাতে কি সমালোচকদের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে?
দুটি মুভ—হ্যাঁ, মাত্র দুটি মুভেই আগের সব বিতর্ক সবুজ গালিচাতেই মাটিচাপা দিয়েছেন নেইমার। প্রথম মুভটা ছিল ৫১ মিনিটে। মেক্সিকান বক্সের বাইরে নেইমার বল পাওয়ামাত্রই তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন তিন ডিফেন্ডার। পেছনেই ওত পেতে ছিলেন উইলিয়ান। তাঁর সামনে দিয়ে বেশ সরু একটা জায়গা ফাঁকা ছিল। নেইমার যেন খেলটা বুঝে নিলেন দাবার মতো। ব্যাক হিলে উইলিয়ানকে পাস দিয়েই শুরু করলেন দৌড়। ব্যাপারটা যে একটা ফাঁদ, মেক্সিকান রক্ষণভাগ তা ধরতে পারেনি।
উইলিয়ান বল পেয়েই বাঁ প্রান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ঢুকে পড়েছিলেন বক্সে। মেক্সিকান ডিফেন্ডারেরা তখন উইলিয়ানকে ঠেকাতে শশব্যস্ত। ওদিকে ডান প্রান্ত দিয়ে নেইমার যে উইলিয়ানের ফিরতি জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় রাফায়েল মার্কেজ-গায়ার্দোরা, তা বুঝতে পারেননি। তিতের অনুশীলনে শেখানো মুখস্থ খেলার মতোই ক্রস করলেন উইলিয়ান। গ্যাব্রিয়েল জেসুস সেই ক্রসে পা ছোঁয়ানোর চেষ্টা করেও পারেননি। হয়তো সৃষ্টিকর্তাই চাননি! আক্রমণটা যিনি তৈরি করেছিলেন, তাঁকে দিয়েই বোধ হয় গোল করানোর ইচ্ছা ছিল। আর তাই নেইমার পা ছোঁয়াতেই গোল! উইলিয়ানের সঙ্গে সামান্য ওয়ান-টু খেলে ছড়ানো এই সৌরভই তো নেইমারের কাছ থেকে চায় ব্রাজিল।
নেইমার কিন্তু এই সৌরভ ছড়াতে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন ৮৯ মিনিটে চকিত এক দৌড়ে। বাঁ প্রান্তে বল পেয়ে রক্ষণ কিছুটা ফাঁকা দেখেই গতি বাড়ান নেইমার। এ গতিটা গত তিন ম্যাচে প্রার্থনা করেও পায়নি ব্রাজিল। কে জানে, নিজের সেরাটা নেইমার হয়তো জমিয়ে রেখেছেন নকআউট পর্বের জন্য। আর তাই মেক্সিকান ডিফেন্ডার তাঁর পেছনে প্রাণপণ ছুটেও ধরতে পারেনি। গোলরক্ষক ওচোয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে ডান পোস্টের কাছে ওত পেতে থাকা ফিরমিনোকে বলটা বাড়িয়ে দেন নিঃস্বার্থের মতো। বলটা জালে পাঠিয়ে ফিরমিনো শুধু নেইমারের ওই দৌড়কে সার্থক করেছেন।
সমালোচকদের মুখ কি তাহলে এবার বন্ধ হবে? পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, এখনই তাঁদের মুখে কুলুপ দেওয়া উচিত। ‘ছুঁয়ে দিলেই পড়ে যায়’—ঠাট্টায় এত দিন যাঁরা নেইমারকে জর্জরিত করেছেন, তাঁরা মুখ খুলবার আগেই জেনে নিন একটি তথ্য—বিশ্বকাপে এ পথ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শট নেইমারের (২৩)। এর মধ্যে গোলপোস্ট বরাবর সর্বোচ্চ ১২ শটও রাখতে পারার সামর্থ্যটুকুও নেইমারের। এখানেই শেষ নয়। সতীর্থদের জন্য সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাঁর পা থেকেই (১৬)। আর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ফাউলের শিকার? সেটাই এই নেইমারই—বেশি না, মাত্র ২৩ বার!
হলুদ জার্সির প্রতি তাঁর এই নিবেদনটুকু কি নেইমারের মাঠে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যকে ভুলিয়ে দিতে সক্ষম? যদি এখনো ভুলতে না পারেন, তাহলে আরেকটু অপেক্ষা করুন। নেইমার-ফুল সবে ফুটতে শুরু করেছে!
[embedyt] https://www.youtube.com/watch?v=z-FPDwNagR8[/embedyt]