কলকাতার সাবেকি পুরনো পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কলকাতার সিংহি পার্কের পুজো। অবস্থান গত ভাবে একডালিয়া এভারগ্রিনের উল্টো দিকের গলিতেই এই পুজোর আয়োজন হলেও চিরকালই নিজস্ব আলোয় আলোকিত সিংহি পার্ক। এ বছর ৭৮তম বর্ষে পদার্পণ করল এই পুজো। মূলত প্রতিবারই দেশের কোনও না কোনও মন্দিরের আদলে তৈরি হয় সিংহি পার্কের মন্ডপ। আগেরবার যেমন গুজরাতের মেহসানা জেলার মোধেরা গ্রামের এক সুপ্রাচীন সূর্য মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছিল মণ্ডপ।
তবে এবার তাদের মন্ডপ হতে চলেছে এক কাল্পনিক মন্দির। এ প্রসঙ্গে সিংহি পার্ক সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার জানান, ‘৭৮ বছরের এই পুজোতে প্রতি বছরই ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয় মন্ডপ। কিন্তু এই চিরাচরিত প্রথা থেকে একটু সরে এসে মন্ডপকে মনগড়া এক মন্দিরের আদল দিয়েছি আমরা। যাতে থাকছে বাংলা তথা উড়িষ্যার বহু প্রাচীন শিল্প পট চিত্রের কাজ। এই পট চিত্রকে সঙ্গী করেই সিংহি পার্কের ৭৮ তম বর্ষের পুজো।’
মন্ডপে পট চিত্র ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিজিৎ বাবু বলেন, বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই সাম্প্রতিক কালে ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ ও অশান্তি লেগেই আছে। তবে এই পট চিত্র যাঁরা আঁকেন তাঁরা সকলেই মূলত পুরুলিয়া বা মেদিনীপুরের মানুষ এবং অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এঁরা সকলেই কিন্তু নিজেদের ধর্ম ভুলে গিয়ে ভারতীয় তথা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি আঁকেন, তাদের জয়গান করেন।
তিনি আরও বলেন যে, এই পটচিত্র দেখাবার একটি নিয়ম আছে। মূলত একটি কাপড়ের ওপর বিভিন্ন ছবি আঁকা থাকে। যখন পটচিত্র দেখানো হয় তখন কাপড়টি ধীরে ধীরে খুলে সেসব ছবি দেখানো হয় এবং তার সঙ্গে একটা গান গাওয়া হয়। সেই গান আসলে বিভিন্ন দেবদেবীর স্তুতি বাক্য। অদ্ভুত ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওই মানুষগুলো হিন্দু দেবদেবীর স্তুতি বাক্য সাবলীল ভাবে পাঠ করেন। তাই সিংহি পার্কের পুজো এবার এই বার্তাই দিতে চলেছে যে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
অভিজিৎ বাবু জানিয়েছেন, গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের প্রাক্তনী শিল্পী শ্রী মিঠুন দত্তের ভাবনা ও সৃজনে সেজে উঠছে তাদের মন্ডপ। তাঁর কথায়, পট ভেজিটেবল কালার দিয়ে তৈরি হয় কিন্তু এটা যেহেতু রাস্তার পাশে এবং এবার পুজোয় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে, তাই এমনি রঙই আমরা এখানে ব্যবহার করছি। মন্ডপ তৈরি হচ্ছে প্লাইউড, থার্মোকল ও কাপড় দিয়ে। কাপড়ের উপর একধরনের ওয়াশ ব্যবহার করে পটের এফেক্ট আনা হচ্ছে। পট সাধারণত টু ডাইমেনশনাল হয়। কিন্তু এখানে আমরা একটু অন্যভাবে পটকে থ্রী ডাইমেনশনাল রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
এর পরই বোমাটা ফাটান অভিজিৎ বাবু৷ তিনি জানান, এ বছর আমাদের মূল আকর্ষণই হল পটচিত্রের মাধ্যমে তৈরি এক অভিনব ঝাড়লণ্ঠন। কলকাতায় এই ধরণের কাজ এর আগে কেউ দেখেনি। সিংহি পার্কেই প্রথম। জুন মাস থেকে দিনরাত কাজ করছেন প্রায় ৪০ জন। এছাড়াও রয়েছে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের কিছু ছাত্র। চিরাচরিত একচালা মাতৃমূর্তি গড়ছেন প্রতিমা শিল্পী ভাস্কর প্রদীপ রুদ্র পাল। প্রতিবারের মতো এবারও থাকছে চন্দননগরের আলো। বিশেষত বাচ্চাদের কথা মাথায় রেখে আলোকসজ্জায় উঠে আসবে নানা কার্টুন ক্যারেক্টর। আবহ সঙ্গীত করেছেন বিখ্যাত তবলাবাদক পন্ডিত সুভেন চট্টোপাধ্যায়।