বিজেপির অন্দরে এ যেন এক যাত্রাপালা। এক পাশে শোভন-বৈশাখী ও বিপরীতে দিলীপ- এই দু’পক্ষের মধ্যে চলছে দড়ি টানাটানির খেলা। একে অপরকে দোষারোপের পালা। একদিকে যদি ওঠে দলে মর্যাদা না দেওয়ার অভিযোগ। তো অন্যদিকে উঠছে শৃঙ্খলা না মানার দোষারোপ। সেই নিয়েই সম্প্রতি উত্তাল বঙ্গ-রাজনীতি। তবে দিল্লীতে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে মুকুল রায়ের বৈঠক পরে আপাত দৃষ্টিতে সমস্যা মিটলেও দেবশ্রী ইস্যু কিন্তু সেই জিইয়েই রইল। কারণ দিল্লীতে এক কথা বললেও কলকাতা নেমেই অন্য সুর দুজনের গলায়। কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শোভন ও বৈশাখীর দাবি করেন, আমাদের সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা মিটে গিয়েছে এটা ভাববেন না। মুকুল দা’কে সবটা বলে এসেছি।
প্রসঙ্গত, বিজেপিতেই থাকছেন, দল ছাড়ছেন না— দিল্লীতে মুকুল রায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে এমনটাই জানিয়েছিলেন সদ্য গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কলকাতায় নেমেই ফের বিজেপিতে দেবশ্রী রায়ের যোগদান সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাঁদের। আর তারপরই যা উত্তর আসে, তাতেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপের অবস্থান আর শোভন-বৈশাখীর অবস্থানের মধ্যে ফারাক আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল। উল্লেখ্য, দিল্লী থেকে শোভনরা কলকাতায় ফেরার আগেই তাঁদের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল দিলীপ ঘোষকে। তিনি প্রথমে বলেন, ‘প্রথম দিকে নতুন জায়গায় সবার সমস্যা হয়। নতুন বউ বাড়িতে এলে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। পরে সবার মন জয় করে বউ থেকে বউমা হয়ে ওঠে।’
মুকুল রায়ের সঙ্গে শোভনদের বৈঠকের পরে বরফ গলার যে ইঙ্গিত মিলেছে, সে প্রসঙ্গে দিলীপ বলেন, ‘মুকুলদা সিনিয়র। সকলকে বুঝিয়ে-বাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ওঁর। উনি সেটা করছেন। সব কিছু ঠিক পথেই যাচ্ছে। কোনও সমস্যা থাকবে না।’ কিন্তু দেবশ্রী রায়কে দলে নেওয়ার বিষয়ে শোভনদের আপত্তির প্রসঙ্গ উঠতেই দিলীপের মেজাজ বদলে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি সকলের সামনে বলছি, কোনও শর্ত ছিল না। আমি কারও শর্ত মেনে চলিনি, মেনে চলবও না। ওই দিন দেবশ্রীর নামই আসেনি। আর কাকে নেব, কাকে নেব না, সেটা সভাপতি হিসেবে আমিই ঠিক করব। আমি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা শুনি। আর কারও কথা শুনে আমি চলি না।’ অন্যদিকে কলকাতা বিমানবন্দরে মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই শোভন-বৈশাখীর কাছে দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ ওঠে।
জবাবে শোভন বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, কোনও পরিবারে নতুন কেউ এলে, তাঁকে নিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তিনি কতটা সহ্য করতে পারবেন, সেটাও মাথায় রাখা উচিত।’ দেবশ্রীর বিষয়ে দিলীপ যা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে শোভন সাফ জানান, ‘দিলীপবাবু ঠিকই বলেছেন। কোনও শর্ত দিয়ে আমরা দলে ঢুকিনি। কোনও পদ চাই বা কোনও দায়িত্ব চাই, এ রকম কিছু বলিনি। কিন্তু দেবশ্রী রায়ের বিষয়ে আমার মতামত কী, সে কথা প্রথম দিনই নাড্ডাজিকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। অরবিন্দ মেনন, কৈলাস বিজয়বর্গীয় বা দিলীপ ঘোষকেও একই কথা বলেছিলাম। কালকে মুকুল রায়কেও সে কথাই বলেছি। মুকুল রায় আমাকে বলেছেন, ওটা নতুন করে বলতে হবে না। কারণ নাড্ডাজির সঙ্গে যখন আমার কথা হয়েছিল, তখন মুকুল রায়ও সেখানে ছিলেন।’
এখানেই না থেমে শোভন আরও বলেন, ‘প্রথম দিনেই আমাকে জানানো হয়েছিল, দেবশ্রী রায় হল ক্লোজড চ্যাপ্টার। তার পরেও রোজ একই প্রশ্ন করলে আমার উত্তর বদলাবে না। রোজ রোজ একই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি নতুন করে আর একটা কথাও খরচ করতে চাই না।’ বৈশাখীও প্রায় একই কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘কাকে দলে নেবেন, কাকে নেবেন না, সেটা অবশ্যই দিলীপবাবুই স্থির করবেন। তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তিনি নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নিন। তার পরে আমরা যা করার করব। আমাদের অবস্থান তো আমরা আগেই জানিয়ে রেখেছি।’ এর থেকেই স্পষ্ট যে, বিজেপির সঙ্গে তাঁদের যে দূরত্ব হয়েছে, মুকুল রায়ের হস্তক্ষেপের পরেও তার ছিঁটেফোঁটাও মেটেনি। যে কারণে দিল্লীতে ‘সমস্যা মিটে গিয়েছে’ বললেও, কলকাতা নেমেই উল্টো সুর শোভন-বৈশাখীর গলায়।