গত ২-৩ দিন ধরে নাটক অব্যাহত থাকার পর স্পষ্ট যে, বিজেপিতে শোভনের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় তলানিতে। দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গে দেখা করে ‘নিষ্কৃতি’ চাওয়ার পরের দিনই দিল্লী চলে গিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। সমস্যা তৈরি হয়ে থাকলে কথা বলে মিটিয়ে নেওয়া হবে— গত কয়েক দিনে একাধিক বার এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দলের রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু বিজেপিতে দেবশ্রী রায়ের যোগদান প্রায় পাকা। তাই সিদ্ধান্ত বদল করার কোনও ইঙ্গিত দেননি শোভন। এই পরিস্থিতিতে শেষ চেষ্টা করতে ময়দানে নেমেছেন মুকুল রায়। শোনা যাচ্ছে, আজ রাতে দিল্লীতেই শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন মুকুল রায়।
শুক্রবার রাতের উড়ানে দিল্লী গিয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিতে তাঁরা দিল্লী গিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। আজ অর্থাৎ সোমবারই তাঁদের কলকাতায় ফিরে আসার কথা ছিল বলে শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর। কিন্তু বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় বার বার অনুরোধ করায় সোমবার আর তাঁরা কলকাতায় ফিরছেন না। মুকুল সোমবার রাতের মধ্যেই দিল্লী পৌঁছচ্ছেন। সূত্রের খবর, দিল্লী পৌঁছেই শোভন ও বৈশাখীকে নিয়ে তিনি বৈঠকে বসছেন।
রায়দিঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়কে দলে নেওয়া হলে তাঁরা যে দল ছেড়ে দেবেন, সে কথা বিজেপিতে যোগদানের দিনই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গ বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেননকে তো বটেই, বিজেপির সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডাকেও তাঁরা সে কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের অনেকেই দেবশ্রীকে দলে স্বাগত জানানোর পক্ষপাতী। দেবশ্রীকে ঘিরে সমস্যা যে তৈরি হচ্ছে, তা রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথায় বার বারই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল গত কয়েক দিনে। ‘দেবশ্রী রায়কে দলে নেওয়ার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি’ বা ‘দেবশ্রী রায়ের বিষয়ে দলের সবার মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে’— এমন কথা দিলীপকে বহু জায়গায় বলতে শোনা গিয়েছে। কিন্তু দলের দরজা সবার জন্য খোলা এবং দেবশ্রী রায়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না— এ কথাও দিলীপ বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
অন্য দিকে শোভনের বাধায় প্রথম দিনে তাঁর যোগদান আটকে গেলেও দেবশ্রী রায় কিন্তু হাল ছাড়েননি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি একনাগাড়ে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। দিলীপ ঘোষের বাড়ি গিয়ে প্রথম দিন দিলীপের দেখা দেবশ্রী পাননি ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে দিলীপের সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন এবং দিলীপ-দেবশ্রীর মধ্যে এই বিষয়ে বিশদে কথাবার্তাও হয়েছে। বঙ্গ বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গেও দেবশ্রী রায়ের বৈঠক হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর।
দেবশ্রীর রায় যদি বিজেপিতে প্রথম অস্বস্তি হন শোভন-বৈশাখীর জন্য, তা হলে দ্বিতীয় অস্বস্তি ‘অমর্যাদা’ সংক্রান্ত অভিযোগ। ২০ অগস্ট রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে শোভন-বৈশাখীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, তার বিজ্ঞপ্তিতে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছিল না। তা নিয়ে টানাপড়েন চরমে পৌঁছয়। পরে আবার রাজ্য কমিটির বর্ধিত বৈঠকে অন্য সাংসদ-বিধায়করা ডাক পেলেও তিনি ডাক পাননি বলে শোভন নিজে অভিযোগ করেছিলেন। যার ফলে ক্রমশ জটিল হয়েছে পরিস্থিতি।
জট যে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে, তা বিজেপি নেতৃত্বও আঁচ করেছেন। শোভনরা দিল্লী চলে যাওয়ার পরে নেতৃত্বের তরফ থেকে বেশ কয়েক জন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত মুকুল রায় কিছুটা সফল হন। শোভন ও বৈশাখীকে তিনি বারবার অনুরোধ করেন, তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত না নিতে। সোমবার সব্যসাচী দত্তের গণেশ পুজোর উদ্বোধন সেরে তিনি দিল্লী যাবেন এবং তত দিন পর্যন্ত শোভনরা যেন দিল্লীতেই থাকেন— মুকুল এমনই অনুরোধ করেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানান। কোনোপক্ষই এই বিষয়েশোভন-বৈশাখীর মান ভাঙিয়ে তাঁদের দলে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা যে মুকুল রায় করবেন এই বৈঠকে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কোনও সংশয় নেই।