বাঙালির আত্মপরিচয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। এমনটাই মনে করেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। রবীন্দ্রসদনে ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘বাংলার ভাষা, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস – সবই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে। বাঙালির আত্মপরিচয়ে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’।
সংস্থার প্রতিষ্ঠা দিবসে ওই সভায় ‘অন বিইং এ বেঙ্গলি’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তৃতা পেশ করেন অমর্ত্য সেন। ছিলেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-অধিকর্তা অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচী। এছাড়াও শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ডঃ অসীম দাশগুপ্ত, অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার প্রমুখ।
বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তাঁর ভাষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভাষীর আত্মপরিচয়ের উৎস ও তার বিশ্লেষণে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাদের। ইংরেজিতে দেওয়া বক্তৃতায় ষোড়শ শতাব্দীর চণ্ডীমঙ্গলের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন মনে করিয়ে দিলেন, বঙ্গে মুসলমানদের আগমনে হিন্দুরা অসন্তুষ্ট হননি, বরং খুশি হয়েছিলেন, কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় বাঘের উৎপাত কমেছিল বহুলাংশে। যে ঢাকার মসলিন এক কালে বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, এমনকি, অ্যাডাম স্মিথকে দিয়েও বলিয়ে নিয়েছিল বাংলার সমৃদ্ধির কথা, তা তৈরি হয়েছিল হিন্দু-মুসলমানের সহযোগিতায়।
চর্যাপদ থেকে শুরু করে মুকুন্দরাম-রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে ভাষা আন্দোলনে আসার দীর্ঘ পথে গ্রহণ-বর্জনে তৈরি হয়েছে যে বাঙালিসত্তা, তা কি ঘৃণার রাজনীতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? অমর্ত্য সেন আশাবাদী, তবে একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না, সেই বাঙালিত্বে পৌঁছনোর আগে হয়তো পেরোতে হবে বহু ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনে পৌঁছনোর আগে যেমন ছেচল্লিশের দাঙ্গার পাপ বইতে হয়েছে বাঙালিকে। অমর্ত্য সেনের সাফ কথা, ‘হিংসা, ঘৃণার পরিবেশের প্রভাব পড়ছে জনজীবনেও। নতুন ভারতে যা বিপজ্জনক। পরিস্থিতিই দাবি করছে, এর বিরুদ্ধে গলা তুলতে হবে। গণতন্ত্রে হিংসার স্থান নেই। এটা বুঝতে হবে সবাইকে’।