এ যেন উলটপুরাণ! যেখানে এখনও শ্বশুরবাড়িটা একটা মেয়ের নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে না, ‘পরের বাড়ির মেয়ে’ এই অনুভূতিটা একটা মেয়ে বয়ে চলে চিরকাল, সেখানে সব চিরাচরিত হিসেব নিকেশ বদলে দিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার মুকুন্দ মাইতি। মুকুন্দ বাবু পরিচয় দিলেন প্রকৃত আধুনিকতার। পুত্রশোক কাটিয়ে যিনি নির্দ্বিধায় নিজের কন্যাস্নেহে বিধবা পুত্রবধূর বিয়ে দিতে পারেন সাড়ম্বরে। গোটা গ্রামকে নিমন্ত্রণ করে পাতপেড়ে খাওয়াতে পারেন। তিনিই তো আসল হিরো আজকের দিনে, তিনিই তো আধুনিক।
গত ৩ ডিসেম্বরের ঘটনা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল বাড়–জিশুয়ার মাইতি পরিবার। পেশায় সোনার কারিগর মুকুন্দবাবুর ছেলে অমিত মহিশূর থেকে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে অসুস্থ হয়ে মারা যান। সেই থেকেই অমিতের স্ত্রী উমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ–যত্নে আগলে রেখেছিলেন নিজের কাছে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন উমাকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু গ্রামীণ এই সমাজে বিধবাকে বিয়ে করার বুকের পাটা কার আছে? কিন্তু চেষ্টায় অনড় ছিলেন মুকুলবাবু। বিধবা জেনেও উমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিলেন পাঁশকুড়া ব্লকের শ্যামসুন্দরপুর পাটনার যুবক স্বপন মাইতি। পেশায় পাঁশকুড়ার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মী। পাকা হয়েছিল সম্বন্ধ।
অবশেষে সোমবার রাতে পুরনো পাঁশকুড়ার বাজারের ভবতারিণীর মন্দিরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চার হাত এক করে দেন স্বপন–উমার। মুকুন্দবাবুর বক্তব্য, ‘যে গেছে, সে গেছে। বাবা হিসেবে সে যাওয়ার যন্ত্রণা আমার চিরকালীন। কিন্তু যে আছে, তার জীবন শূন্যতায় ভরে থাকবে কেন? ছেলে হারানোর পর মনকে শক্ত করে ফের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি। আমি শুধু তার ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজের মেয়ে হলে বাবা হিসেবে তার পুনর্বিবাহ চাইতাম। এক্ষেত্রেও আমি সেটুকুই করেছি। অমিতের মৃত্যুর পর মাঝে একবার চার মাসের জন্য বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছিল উমা। কিন্তু সেখানে থাকতে না পেরে আবার ফিরে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে। আর বউমা থেকে ক্রমেই বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠেছিল। এভাবে একা বাঁচা যায় না। তাই তার দীর্ঘ ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে পুনরায় বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।’
দ্বিতীয় বিয়েতে উমা অবশ্য গোড়ায় রাজি ছিলেন না। কিন্তু মুকুন্দ হাল ছাড়েননি। পরে উমাকে বুঝিয়ে রাজি করান মুকুন্দ। সব জেনেই উমাকে বিয়ে করতে রাজি হন পাঁশকুড়ার মাইশোরার শ্যামসুন্দরপুর পাটনা গ্রামের স্বপন মাইতি। পাঁশকুড়া সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চুক্তিভিত্তিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী স্বপনের বাবা-মাও রাজি হন। মঙ্গলবার স্বপনের বাড়িতে ছিল বৌভাত। স্বপন বলছেন, ‘‘আমি মন থেকেই এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তবে এই বিয়েতেও সায় ছিল না উমার বাপের বাড়ির। আমন্ত্রণ জানালেও আসেননি কেউ। উমাও বলছেন, ‘‘মুকুন্দপুর নয়, আমার বাপের বাড়ি বাড়জেশুয়ায়।’’ অষ্টমঙ্গলায় ওই বাড়িতেই ফিরবেন উমা।