আমি একজন মূর্খ মানুষ। নিজের মূর্খতা ধরা পড়ে যাবে তাই আন্তর্জাতিক কোন সমস্যা নিয়ে কিছু বলিনা। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থী অনুপ্রবেশ আটকানোর নামে শিশুদের তাদের বাবা মার থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে নৃশংস কান্ডটি ঘটাচ্ছেন সারা পৃথিবী জুড়ে তার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। বোঝাই যাচ্ছে শরণার্থীদের ভয় দেখাতেই তাদের সন্তানদের আটক করছেন তিনি। এই অমানবিক অত্যাচারের প্রতিবাদ না করলে আমরা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করতে পারবো না। অনুপ্রবেশ রুখতে ট্রাম্প নিদান দিয়েছেন শরণার্থী পরিবারগুলির শিশুদের তাদের পরিবার থেকে একবছরের জন্য বিচ্ছিন্ন করা হবে। তারা থাকবে কোন হোম বা আশ্রয় শিবিরে। একবছর পরে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আধুনিক পৃথিবী বহুদিন পর এমন তুঘলকি ফরমান শুনলো।
শুধু কথায় আটকে না থেকে একাজ ট্রাম্প শুরুও করে দিয়েছেন। এর পরিণতিতেই পরিবার বিচ্ছিন্ন ১৫০০ শিশু নিখোঁজ। সে দেশেরই সরকারি সূত্র অনুযায়ী আসলে নিখোঁজ হয়েছে ৬০০০ শিশু। যে দেশের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, গণতন্ত্রকে মানুষের সরকার বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সে দেশের প্রেসিডেন্টের এমন কাজকর্ম দেখে লোকের চোখ কপালে উঠেছে। সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আরও স্বাভাবিক কাজ হল ট্রাম্পের এই শিশুবিরোধী অমানবিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সারা বিশ্বেই এখন এই প্রতিবাদ দানা বাঁধছে।
টাম্প বস্তুত ভুলভাল, শয়তানসুলভ এবং হাস্যকর কথা ও কাজের একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ছাড়া সারা বিশ্বের তো বটেই এমন কি আমেরিকাতেও কোন স্তরের মানুষই তার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন না। সরব হয়েছেন গণতন্ত্র ও স্বাধীকারপ্রেমী সে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সাধারণ মানুষ। অথচ কূটনৈতিক সৌজন্যের দোহাই দিয়ে প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-র মত রাজনীতিবিদ। তিনি বলেছেন, বাচ্চাদের খাঁচায় বন্দী রাখার যে ছবি আমেরিকা থেকে আসছে আমরা তার সঙ্গে একমত নই। প্রতিবাদ করেছেন বিখ্যাত অভিনেতা আর্নল্ড সোয়ারৎজেনেগার। প্রতিবাদ জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। কিন্তু চিরকালের ‘প্রতিবাদ মুখর’ ও ‘প্রবল আন্তর্জাতিকতাবাদী’ আমাদের বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা যাকে বলে একেবারে স্পিকটি নট। সেমিনার, মিটিং, মিছিল, পদযাত্রা, পোস্টারিং, প্রতিবাদ সভা কোনকিছুই এখনও তেমন চোখে পড়েনি। এটা আমার খুব অবাক লেগেছে! হয়তো প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা বালখিল্য শিশুদের ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনকিছু বলাটাকে অপরাধ মনে করেন। হয়তো তারা ভাবছেন আমার সন্তানটি দুধেভাতে থাকলেই সবকিছু ঠিক থাকবে। একটা কথা মনে রাখবেন, যে কোন অন্যায় প্রতিবাদহীন ভাবে ঘটে চললে তা প্রসারিত হয়।
একসময়ে যে কলকাতার মানুষ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন থেকে শুরু করে চিনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে সেনাদের গুলি করে মানুষ মারা অব্দি নানা প্রশ্নে সরব হয়েছিল তারাই এই শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রায় নীরব। অথচ জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা সবাই শরণার্থী সমস্যাটি সম্পর্কে অবহিত। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! কে যে কীসে প্রতিবাদ করে তা সত্যিই বোঝা দায়। আমার খুব অবাক লাগে পশ্চিমবঙ্গ এই ঘটনায় বাকরুদ্ধ কেন? দেশ-এর প্রচ্ছদের বাইরে বেরিয়ে দু এক লাইন লিখে কবিরাও তো প্রতিবাদ জানাতে পারতেন! পশ্চিমবঙ্গে কিছু ঘটলে আপনারা তো কোমরে গামছা বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়েন। দুর্জনেরা বলেন এর কারণ আছে। তা হল আমেরিকার বিরুদ্ধে সরব হলে নানা অনুষ্ঠানে মার্কিন কনস্যুলেটের পার্টিতে নেমন্তন্ন পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কিংবা পাওয়া যাবেনা সেদেশের কবিতার ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়া বা কবিতা পাঠের সুযোগ। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিকরা পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নিয়ে দিনরাত লিখে চলেছেন তারাও এ প্রশ্নে নীরব। টিভিতে যে বুদ্ধিজীবীরা ফ্যাব ইন্ডিয়ার ডিজাইনার পাঞ্জাবি পরে প্রতিপক্ষকে তুলোধোনা করেন তারাও যেন কেমন চুপচাপ। কি হল ভাই আপনাদের?
নানা ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর আমার সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক বন্ধুরাই বা কোথায়? পুলিশ ও রাজ্যসরকার ছাড়া প্রতিবাদের কি অন্য কোন বিষয় নেই? কোথায় গেলেন যাদবপুরের ‘হোক কলরব’ পন্থীরা। তারা তো ‘খোঁজখবর’ রাখা ছেলেমেয়ে! সাধারণ মানুষের অসুবিধা করে রাস্তা বন্ধ করে সরকারকে গাল পারার সময় তো আপনারা জেগে ওঠেন! এত শিশুর মৃত্যু কি আপনাদের চোখে পড়ছে না? একদা প্রবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ‘বিরোধী’ সিপিএম আগে তো নানা বিষয় নিয়ে মার্কিন কনস্যুলেট ঘেরাও করতেন, প্রতিবাদ জানিয়ে স্মারকলিপি দিতেন কনস্যুলেটের কর্তাদের। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তাদেরও গলার জোর কমে গেছে।
ভারতের নিন্দায় আমরা ভারতীয়রাই সবচেয়ে বেশি মুখর। কিন্তু সেই ভারতকেই কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে লাগাতার ভাবে শরণার্থীদের স্রোত সামলাতে হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের মত অমানবিক সিদ্ধান্ত আমাদের রাষ্ট্রনায়করা কেউই নেন নি। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে একটা দৃষ্টান্ত। দেশে ও বিদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অমানবিক ভাবে আটক করা, তাদের শিশুদের ওপর নির্যাতন করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন দিদি। সমস্যা না মেটা পর্যন্ত তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সবরকম সক্রিয় সহায়তা দিয়েছেন। ট্রাম্পকে দেখে আমার মনে পড়ছে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’ লাইনটার কথা। অসহায় মানুষগুলির কাছ থেকে তাদের সবচাইতে বড় অবলম্বন, সবচাইতে স্নেহের জিনিস সন্তানদের কেড়ে নিচ্ছেন পৃথিবীর সবচাইতে ধনী রাষ্ট্রপ্রধান। শিশু গুলিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। জীবনের সবচাইতে জরুরি সময়ে বাবা মার স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। আসুন, এর প্রতিবাদ করি।
অনেকে বলবেন কেন রাজনৈতিক দলগুলিও তো এর প্রতিবাদ করতে পারে। নিশ্চয়ই পারে কিন্তু এই মানবিক প্রশ্নে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সরব হলে আরও বেশি মানুষ এতে সামিল হবে। কেউ বলতে পারেন মেক্সিকো সীমান্তের এই ঘটনায় কলকাতায় প্রতিবাদ করে কি হবে? তাদের জানাই সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করছেন। কলকাতা তাতে সামিল হলে ট্রাম্প বিরোধী আওয়াজ আরও জোরদার হবে। আমেরিকার ওপর একটা চাপ তৈরি করা যাবে। ভাবমূর্তি রক্ষার দায়েই তখন পিছু হটবে আমেরিকা। বন্ধ হবে সীমান্তে বিছিন্ন হওয়া পরিবারগুলির শিশুদের একবছর অন্যত্র আটকে রাখার সিদ্ধান্ত। আমাদের প্রতিবাদ তাদের ভয় দেখাক, কলকাতা হয়ে উঠুক শরণার্থী রোখার নামে মানবতাকে ধ্বংস করা ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনের একটি অংশ। আমরা যেন মনে রাখি পৃথিবীর সব প্রান্তেই শিশুদের জন্ম ও মৃত্যু একইরকম। সব শিশুই বাবা-মা বলে।