শতবর্ষের রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে ইস্টবেঙ্গল। জেলায় জেলায় লাল-হলুদ সমর্থকদের উদ্যোগে শুরু হয়েছে শতবর্ষ উদযাপন। শুধু জেলায় নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমনকি বিদেশেও শতবর্ষ পালন হচ্ছে। সমর্থকদের পাশাপাশি সেখানে যোগ দিচ্ছেন প্রাক্তন খেলোয়াড়রাও। বাইচুং থেকে শুরু করে অ্যালভিটো, সুভাষ ভৌমিক থেকে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সবাই সামিল হয়েছেন এই উৎসবে। আর এরমধ্যেই মনোরঞ্জনকে নিয়ে পড়লেন কয়েকজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। আসলে এখনও কট্টর ইস্টবেঙ্গলপন্থীদের একাংশ মেনে নিতে পারেননি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গঙ্গাপাড়ের ক্লাবে যোগদানের ব্যাপারটা। প্রিয় ‘মনা’ ইস্টবেঙ্গলেই চিরকাল খেলে যাবে, এই বদ্ধমূল ধারণাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, লাল–হলুদ গ্যালারির জনপ্রিয়তম ফুটবলার সবুজ–মেরুন শিবিরে যোগ দেওয়ায়। এটা ইস্টবেঙ্গল শিবিরের যন্ত্রণা এখনও। ভবিষ্যতেও থাকবেও।
মনাই সেরা, মনাই ভরসা, তবু কেন যে ইস্টবেঙ্গল ছেড়েছিলেন— এ জাতীয় আপসোস ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে ভবিষ্যতে থাকবেও। এ প্রসঙ্গটা রবিবার উঠতেই মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বললেন, “শতবর্ষ চলছে। আমি চাই না এই উৎসবের আবহটা নষ্ট হয়ে যাক। প্লিজ আমাকে পীড়াপীড়ি করবেন না উত্তরের জন্য। তবে, মৃত্যুর আগে অবশ্যই বলে যাব, কেন মোহনবাগানে গিয়েছিলাম।” এরপর আর তাঁকে কেউ বিরক্ত করেননি।
বছরের পর বছর অজস্র ফুটবলার লাল–হলুদ জার্সি গায়ে খেলে গিয়েছেন। তবু কেন লাল–হলুদ জনতা তাঁর নামের মধ্যে পান অদ্ভুত এক আশ্রয়, “কেন হয়, জানি না। কীভাবে হয়েছে, বলতে পারব না। নিজের হয়ে কোনও সার্টিফিকেট দেব না। এটা জনতার বিচার, জনতার রায়। তবে আমি প্রতি মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গলে খেলার জন্য গর্বিত ছিলাম, এখনও আছি, থাকবও।”
ওঁর কথায়, “ইস্টবেঙ্গল জনতা জানে টাকাপয়সা নিয়ে আমার সঙ্গে কোনওদিন কোনও বিরোধ হয়নি ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের। আমি চুক্তির বাইরে টাকা বাড়িয়ে নিইনি কখনও। আমার সঙ্গে চুক্তির আলোচনা করতে সময়ও বিশেষ লাগেনি। তাঁরা ভালোমতো জানে, এই ক্লাবের জন্য আমি কখন কীভাবে আত্মত্যাগ করে গিয়েছি বছরের পর বছর। হয়তো এই ব্যাপারটাতেই ওরা সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হতে হতে ভালবেসে ফেলেছে আমাকে। তাই, হঠাৎ করে মোহনবাগানে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কখনই আমাকে ইস্টবেঙ্গল জনতা বিব্রত করেনি। এজন্য আমি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কথা উঠলেই কেন সবার আগে তাঁর নাম উঠে আসে? এটা সম্ভব হয়েছে ওঁর ধারাবাহিক সফল হওয়ার কারণে। বিশেষ করে ১৯৮০ সালে যখন দলের ৮০ শতাংশ ফুটবলার অন্য দুই প্রধানে চলে গিয়েছিলেন, তখন কিন্তু মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছাড়েননি। নিবু নিবু হয়ে আসা মশালকে নতুন উদ্যমে জাগিয়ে তুলেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হল, ওই ’৮০ সালে ইস্টবেঙ্গল হেরেছিল মাত্র ১টি ম্যাচে, গোটা মরশুমে। তাও সেটা ডিসিএম–এ, দক্ষিণ কোরিয়ার একটা দলের কাছে। ওই ভাঙাচোরা দল নিয়ে ফেডারেশন কাপ পর্যন্ত জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল।
ইস্টবেঙ্গলে আসা সেরা বিদেশি জিজ্ঞাসা করতেই তিনি একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন মজিদের নাম। তিনি বলেন, “কলকাতা তথা ভারতে মজিদ বাসকারের মতো কোয়ালিটি ফুটবলার আসেনি। আবার বলি, মজিদের জাতের কোনও তুলনা নেই। কেউ কেউ হয়তো চিমা ওকোরির নাম বলবে। মজিদের চেয়েও চিমা অনেক বেশি সার্ভিস দিয়েছে ইস্টবেঙ্গলকে। কিন্তু কোয়ালিটির বিচারে মজিদ বাসকার থাকবে শীর্ষে।”
লাল–হলুদ শিবিরে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন সত্যিকারের এক বিগ ব্রাদার হিসেবে। তাই ‘মনাদা’র ছায়ায় আসতে চাইতেন, থাকতে চাইতেন অনেক ফুটবলার। এ কারণেই তো ইরান থেকে মজিদ বাসকার এখনও জানতে চান, হাউ ইজ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য? বিদেশি হয়েও, লাল–হলুদ শিবিরের আসল নায়ককে মজিদ কিন্তু চিনে ফেলেছিলেন আগেই। পি কে ব্যানার্জির মতো কোচ তাঁকে লৌহমানব হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ সব জানেন বলেই ইস্টবেঙ্গল জনতা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর মোহনবাগানে যাওয়ার ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে তাঁকেই সম্মানের সিংহাসনে বসাতে চান, ক্লাবের শতবর্ষের আনন্দের রোশনাইয়ে।