গতকাল কুমোরটুলি থেকে ইস্ট বেঙ্গল তাঁবু পর্যন্ত খেলোয়াড় ও সমর্থকদের র্যালিতে কলকাতার রাজপথের রং ছিল লাল হলুদ। ইস্টবেঙ্গলের শতবার্ষিকী বলে কথা! তাই এই দিনটিকে তো স্মরণীয় করে রাখতেই হবে। সকাল থেকেই বেশ উৎসবের মেজাজে ছিলেন সমর্থক এবং আয়োজকেরা। মহা সমারোহেই শুরু হয় এই শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। তবে এই উৎসবের আবহেও ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের গোলকিপার অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শতবর্ষের সেরা অধিনায়ক সুধীর কর্মকারের মনে মেঘ জমে রয়েছে। কারণ সুধীর-অরুণের আর্জি এই বিশেষ দিনে অজয় শ্রীমাণিকেও সম্মান জানাক ক্লাব।
‘‘শতবর্ষে শ্রীমাণিদার নামে পুরস্কার চালু করতেই পারত ইস্টবেঙ্গল। তা হলে ওঁকে যোগ্য সম্মান জানানো হত।’’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চলেন অরুণবাবু। তাঁর সুরেই সুর মিলিয়ে সুধীর বলছেন, ‘‘সেরা অধিনায়কের সম্মান আমাকে দিচ্ছে ক্লাব। শ্রীমাণিদা তখন ফুটবল সচিব ছিলেন। তাঁকেও যদি সম্মান জানানো হত, তা হলে ক্ষতি তো কিছু হত না।’’
দুই ফুটবলারেরই বক্তব্য, লাল-হলুদের প্রাক্তন ফুটবল-সচিব অজয় শ্রীমাণিকেও শতবর্ষ অনুষ্ঠানে ক্লাবের সম্মান জানানো উচিৎ ছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পুরস্কার তুলে দেওয়া হচ্ছে না শ্রীমাণিবাবুর হাতে। এটাই মানতে পারছেন না দুই প্রাক্তন তারকা।
শতবর্ষের সেরা অধিনায়ক দেওয়া হচ্ছে সুধীর কর্মকারকে, সংবাদপত্রের পাতায় এই খবর পড়ার পরেই দূরভাষে প্রাক্তন লাল-হলুদ ডিফেন্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অজয়বাবু। বিকেলে সুধীর বলছিলেন, ‘‘ফুটবলারদের সঙ্গে একজন ফুটবল সেক্রেটারির সম্পর্ক ভাল হলে, মাঠে জানপ্রাণ লড়িয়ে দেয় খেলোয়াড়রা। আমাদের সঙ্গে শ্রীমাণিদার সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল। সেই কারণে ক্লাব ওঁর সময়ে এত সাফল্য পেয়েছে।’’ সেই মানুষটাকে উপেক্ষা করা ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেননি দুই প্রাক্তন ফুটবলার।
১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলের বারের নীচে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য খেলেছিলেন অরুণ। কলকাতা লিগে একটি গোলও হজম করেননি তিনি। স্মৃতিরোমন্থন করে অরুণ বলছেন, ‘‘১৯৭২ সালে শ্রীমাণিদা আমাদের সবাইকে নিজের পয়সায় সোনার আংটি কিনে দিয়েছিলেন। অনেকেই জানেন না শ্রীমাণিদার এই কথা। আমি অবশ্য সেই আংটিটা আমার নাতনিকে দিয়েছি। শ্রীমাণিদার কাছ থেকে অনুমতি আগেই চেয়ে নিয়েছিলাম। উনি বললেন, অবশ্যই তোমার আংটিটা নাতনিকে দেবে।’’ ইস্টবেঙ্গল অবশ্য শতবর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তিন জনকেই। তবে তাঁরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গিয়েছে। অরুণবাবু বললেন, ‘‘ভাল করে ক্লাব শতবর্ষ অনুষ্ঠান করুক। এটাই চাই। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না।’’
১৯৭০-৭৫ সাল পর্যন্ত লাল-হলুদের কর্তা ছিলেন অজয় শ্রীমাণি। তাঁর সময়ে ইস্টবেঙ্গল টানা পাঁচ বার লিগ জিতেছে। পাস ক্লাব, পিয়ং ইয়ংয়ের মতো বিদেশি ক্লাবকে মাটি ধরিয়েছে। শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দিয়েছে। ক্লাবের শতবর্ষে সেই মানুষটার হাতে কিছু তুলে না দেওয়ায় মন ভাল নেই অরুণ ও সুধীরের। যদিও যাকে নিয়ে এত কিছু সেই শ্রীমাণি কিন্তু এসব শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন সবটা। ৮৫ বছরের শ্রীমাণি বললেন, ‘‘আমার ছেলেদের তো চিনি আমি। ওরা তো এ কথা বলবেই। সুধীরের শরীর খারাপ হয়েছিল। আমি ওকে দেখতে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। সুধীর আমার ডিফেন্সের লিডার। ওর মতো ছেলে আর হবে না।’’আসলে যারা নিঃস্বার্থ ভাবে খেলে গেছেন তাঁদের কাছে এই পুরষ্কার মনে হয় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মাঠের ওই ৯০ মিনিটের আবেগটা, লড়াইটাই সব।