তালিকার শীর্ষস্থানে অবস্থান করে বিশ্ব ক্রিকেটে রাজত্ব করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বলা যেতে পারে, এবারের বিশ্বকাপটা যেন তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত। যার ঝুলিতে অসংখ্য রেকর্ডের ছড়াছড়ি। কথা হচ্ছে সাকিব আল হাসান কে নিয়ে। তিনি যেন প্রতিটি ম্যাচেই খেলতে নামেন রেকর্ড করার জন্যই। এই বিশ্বকাপেই বেশ ক’টি রেকর্ড গড়েন সাকিব আল হাসান।
দেশের জার্সিতে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ১১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন তিনি এবং দ্বিতীয় বাংলাদেশী বোলার হিসেবে তুলে নিয়েছেন ২৫০ উইকেট। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই ৫০০ উইকেট শিকার ও ১১ হাজার রানের ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন অনেক আগেই। এছাড়াও একদিনের ক্রিকেটে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে ৫,০০০ রান ও ২৫০ উইকেট শিকারের তালিকায় নাম আছে তার। এমনকি একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থেকেই তিনটি বিশ্বকাপ আসরে খেলার রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
এবারের বিশ্বকাপে টাইগার বাহিনী দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে তাদের সেরাটা দেওয়ার লক্ষ্যেই পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ডে। অপরদিকে গতবছর ওয়ানডে ক্রিকেটে অলরাউন্ডারের তালিকা হতে নিজের স্থান হারানো সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে নিজের আসনে বসেই শুরু করেন এবারের বিশ্বকাপ যাত্রা।
গত ২ জুন চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে শুভসূচনা করেন বাংলাদেশের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। তবে দলীয় ৭৫ রানের মধ্যেই দুই ওপেনার সাজঘরে ফিরে যান। কিন্তু থেমে থাকেনি রানের চাকা। অসাধারণ এক জুটি গড়ে দলকে ভালো সংগ্রহ এনে দেন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। এর মধ্য দিয়ে সাকিব আল হাসান চলতি বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত প্রথম হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। হাফসেঞ্চুরি করেন মুশফিকুর রহিমও। পরে সাকিব ৮৪ বল খেলে ৮টি চার ও ১টি ছয়ে ৭৫ রান করে আউট হয়ে যান। সাকিব ও মুশফিকের ১৪১ বলে ১৪২ রানের জুটিটি ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সেই ম্যাচেই সাকিব ১০ ওভার বল করে ৫০ রান দিয়ে ১টি উইকেট সংগ্রহ করেন। সেদিনের পারফরম্যান্সে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন সাকিব।
এরপর বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লড়ে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচেও বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে খুব বেশি ভালো করতে না পারলেও সাকিব আল হাসান তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ৬৮ বল খেলে ৭ টি চারের সুবাদে ৬৪ রান করেন তিনি। যদিও ম্যাচটি নিউজিল্যান্ড ২ উইকেটের ব্যবধানে জয়ী হয়। নিউজিল্যান্ডের সাথে হারের পর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের প্রতি পাহাড় সম টার্গেট ছুড়ে দেয় ইংল্যান্ড৷ ৩৮৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। তবে এ ম্যাচেও সাকিব আল হাসান ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তুলে নেন বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি৷ ১১৯ বলে ১২টি চার ও ১টি ছয়ে ১২১ রান করেন সাকিব। তার অনবদ্য সেঞ্চুরির বিপরীতে বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা ছিলেন নিষ্প্রভ। ফলে ১০৬ রানের বড় ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ।
টানা দুই ম্যাচে হার ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হবার কারণে বেশ ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেমিফাইনালের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটিতে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। তবে তাদের দেওয়া ৩২২ রানে লক্ষ্য তাড়া করাটা বেশ কঠিনই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের দুর্দান্ত শুরু এবং সাকিব আল হাসানের ‘ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি’র সাথে লিটন দাসের অনবদ্য ৯৪ রানের অপরাজিত ইনিংসের সুবাদে ৫১ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটের সহজ জয় পায় বাংলাদেশ।
এরপরের ম্যাচটি ছিল এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ম্যাচটিতে ডেভিড ওয়ার্নারের ১৬৬ রানের বিধ্বংসী ইনিংসের পাশাপাশি অ্যারন ফিঞ্চ ও উসমান খাজার হাফসেঞ্চুরির সুবাদে ৫ উইকেটে ৩৮১ রানের বিশাল স্কোর গড়ে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে বেশি রান তুলতে না পারলেও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সাকিব ও তামিম ৭৯ রান তুলেন। এরপর সাকিব আল হাসান ৪১ বল থেকে ৪১ রান করে সাজঘরে ফিরে যান। তারপর লিটন দাস দ্রুত আউট হলে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ শতরানের একটি জুটি গড়েও দলকে জেতাতে পারেননি। তবে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ৬৯ এবং মুশফিকুর রহিমের অপরাজিত ১০২ রানের সুবাদে ৮ উইকেটে ৩৩৩ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। যা বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান।
সেমিফাইনালে টিকে থাকার লড়াইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ম্যাচে আফগানদের যেন সাকিব একাই বশ করে ফেলেছিলেন। ব্যাট হাতে ৫১ রান এবং বল হাতে ২৯ রান দিয়ে ৫টি উইকেট তুলে নেন, যা সাকিবের ওয়ানডে ক্রিকেট ও বিশ্বকাপে সেরা বোলিং ফিগার। সাকিবের অলরাউন্ডিং পারফর্ম ও মুশফিকের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে ৬২ রানের জয় পায় বাংলাদেশ। এই জয়ে এখন পর্যন্ত ৭ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে পরের দুটি ম্যাচও জিততে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে, কিন্তু একক লড়াইয়ে ৬ ম্যাচে ব্যাট হাতে ৪৭৬ রান ও বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে এখনো টুর্নামেন্টে সেরা সাকিব আল হাসান।
গত ১২ ইনিংসে ১০ বার পঞ্চাশোর্ধ্ব রান। শচীন টেন্ডুলকারের ১৬ বছরের পুরনো রেকর্ড ছোঁয়া এক বিশ্বকাপে সাতটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলে। ২০১৯ বিশ্বকাপে নিজের খেলা সবগুলো ম্যাচে চল্লিশোর্ধ্ব রান। বিশ্বকাপ ইতিহাসেই তেন্ডুলকারের পর সর্বোচ্চ ১০ টা অর্ধশতরানও তাঁরই। এই মুহূর্তে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, সেটাও একটা লম্বা মার্জিনে। শচীন-হেডেনের পর এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের তালিকায় নামটা এখন তারই। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বাউন্ডারি এই বিশ্বকাপে (৬০), দ্বিতীয় অবস্থানে বেয়ারস্টো (৫৫)। সাথে ১১ উইকেটের কথাও ভুললে চলবে না, ২০১৯ বিশ্বকাপে সেরা স্পিনার এখন পর্যন্ত তিনিই।
টুর্নামেন্ট সেরা হবেন কি না, বলা কঠিন। কিন্তু দাবিটা দারুণভাবে জানিয়ে রাখলেন সাকিব, হয়ে উঠলেন সর্বকালের সেরাদের একজন। হয়ে উঠলেন বাঙালির মান, বাঙালির শান!