নির্বাচনী প্রচারে অধিকাংশ বিজেপি নেতৃত্বের মুখে উঠে এসেছে দেশপ্রেম। ইস্যু হয়েছিল ‘সেনা’। ‘সেনা’ নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাল হয়েছিল দেশ। রাজনৈতিক মহলের এক বড় অংশের মতে এই ইস্যুর জোরেই দ্বিতীয় বারের জন্য দিল্লীর মসনদে ফিরেছে মোদী সরকার। কিন্তু এটা কি ছিল শুধুই বিজেপির ভোটে জেতার জন্য এক কৌশল? প্রশ্ন জাগছে ভোট পরবর্তী গেরুয়া শিবিরের কর্মকান্ডে। সেনাবাহিনীতে চাকরি ৩০ বছর। তার পর আসাম বর্ডার পুলিশে কর্মরত। এ হেন সেনা অফিসার মহম্মদ সানাউল্লাকেই ‘বিদেশি’ বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করেছে রাজ্যের বিজেপি সরকার। কিন্তু সেই ‘বিদেশি’ চিহ্নিতকরণ নিয়েই এবার উঠে এল বিস্ফোরক তথ্য। যার ফলে প্রশ্ন উঠে গেল গোটা প্রক্রিয়া নিয়েই।
সানাউল্লার তদন্তে তাঁর গ্রামের যে তিন জনের স্বাক্ষর রয়েছে, তাঁরাই দাবি করলেন, কোনও তদন্তই করা হয়নি। তাঁদের সঙ্গে কথাই বলা হয়নি। তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার চন্দ্রমল দাসের বিরুদ্ধে তিন জনই আলাদা আলাদা করে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর চন্দ্রমল দাস আবার আরও বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন। আসাম বর্ডার পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্তার বক্তব্য, সানাউল্লার বিরুদ্ধে কোনও তদন্তই হয়নি। সানাউল্লা নামে এক জনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট তিনি জমা দিয়েছেন। কিন্তু সেই সানাউল্লা এই সুবেদার সানাউল্লা নন। প্রশাসনিক স্তরে কোনওভাবে রিপোর্ট মিশে গিয়ে গন্ডগোল হতে পারে।
প্রসঙ্গত, সানাউল্লার বাড়ি অসমের কামরূপ জেলার কলহিকশ গ্রামে। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্টে যে তিন জনের সই রয়েছে, তাঁরা চন্দ্রমল দাসের বিরুদ্ধে ‘সাজানো’ রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের সঙ্গে কেউ কথাই বলেননি বলে দাবি তিন জনেরই। তাহলে কীভাবে তাঁদের বয়ান নথিভুক্ত হল রিপোর্টে? এই প্রশ্নের সদুত্তর নেই চন্দ্রমল দাসের কাছেও। গ্রামবাসীদের আরও দাবি, যে সময়কালের মধ্যে আসানাউল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, সেই সময় তিনি গ্রামেই ছিলেন না। সানাউল্লার সার্ভিস রেকর্ডও সেই কথাই বলছে। এই সব বিস্ফোরক তথ্য উঠে আসার পর তাঁকে বিদেশি চিহ্নিত করা এবং আটক করার পদ্ধতি নিয়েই বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল।
সানাউল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্টে নাম রয়েছে কুরান আলির। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, এই বিষয়ে ‘কখনও কোনও পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি। আমাকে কখনও তদন্তের জন্য কোথাও ডাকাও হয়নি।’ আরও আশ্চর্যের বিষয়, সানাউল্লার তদন্ত হয়েছে ২০০৮ সালের মে মাস থেকে ২০০৯ সালের অাগস্ট মাসের মধ্যে, কিন্তু ওই সময় তিনি গ্রামেই ছিলেন না বলে দাবি কুরান আলির। তিনি বলেছেন, “২০০৮-’০৯ সালে (ওই সময়ই সানাউল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়) আমি গুয়াহাটিতে ছিলাম।” আবার সানাউল্লার সার্ভিস রেকর্ডও বলছে, ওই সময় জঙ্গী দমন অভিযানের জন্য মণিপুরে কর্মরত ছিলেন তিনি। তদন্তকারী অফিসার চন্দ্রমল দাসও সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।
কুরান আলির মতো প্রায় একই বয়ান সানাউল্লার রিপোর্টে উল্লেখ অন্য দুই গ্রামবাসী আমজাদ আলি এবং সাবাহান আলির। তাঁরাও অভিযোগ দায়ের করেছেন পুলিশে। তিন গ্রামবাসীর অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসার ভাস্করজ্যোতি মহন্ত জানিয়েছেন, ফরেনার্স ট্রাইবুনালে নির্দেশ অনুযায়ী এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জী এবং ফরেনার্স ট্রাইবুনাল নিয়ে আসামের বাসিন্দাদের ক্ষোভের অন্ত নেই। সানাউল্লার ঘটনা সামনে আসার পর সরব হয়েছে ওই অংশও। তাঁদের বক্তব্য, এক জন প্রাক্তন সেনা অফিসারেরই যদি এমন হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত।