২৩ মে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতেই দেখা গেছে, দেশ থেকে প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে বামেরা। রীতিমত গোহারা হারতে হয়েছে তাদের। কেরালা, বিহার, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র- সব জায়গাতেই ভরাডুবি হয়েছে বামেদের। একদা টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা এ রাজ্যে ৪২ টি আসনের একটিতেও জেতা তো দূরের কথা, দ্বিতীয় স্থানও পায়নি তারা। কয়েকটি আসনে আবার চতুর্থ! যে আসনের ওপর সবার নজর ছিল এবং বামেদের আশাও ছিল জেতার সেই যাদবপুর আসনেও বিজেপি-র থেকে কম ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সিপিএম।
এই পরিস্থিতিতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি নিজেদের ক্ষোভ উগড়ে দিলেন নিচুতলার যুব ও পার্টি কর্মীরা। তাঁদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি লিখলেন তাঁরা।
চিঠি লেখা হয়েছে, ‘কমরেড, যে সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে তাতে আর কোন ভুল, কোন গাফিলতির জায়গা নেই। ১০০ বছরের বাংলার উজ্জ্বল কমিউনিস্ট আন্দোলন আজ মুছে যাওয়ার মুখে। তাই আমাদের কিছু কথা আপনাদের শুনতেই হবে।
১. মানুষ, বিশেষ করে আমাদের সমর্থক দরদী, এমনকি পার্টিকর্মীদের একটা অংশ বিজেপি কে ভোট দিয়েছে স্রেফ আমাদের তৃণমূল কে তাড়াবার অযোগ্য ভেবে। কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা বাদে কোথাও আমরা তৃণমূলকে ইটের জবাব পাটকেলে দিতে পারি নি স্রেফ কেন্দ্রীয় নীতির অভাব ও নেতাদের বড় অংশের নিষ্ক্রিয়তার ফলে।
২. আমাদের কর্মীরা যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের পাশে আর্থিক, মানসিক, আইনগত কোন সাপোর্ট আমরা ধারাবাহিক ভাবে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। সেখানে বিজেপি বারংবার গিয়ে তাদের একাংশকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। নেতারা খোঁজই রাখেনি।
৩. রাজ্য থেকে এরিয়া সর্বত্র কনফর্মিস্ট, আপোষকামী ও কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করেছে নেতৃত্ব। পছন্দের তল্পিবাহকদের পদে বসিয়ে লড়াকু, যোগ্য কমরেডদের ‘হঠকারী’ আখ্যান দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৪. প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে ১০ গোল দিয়েছে বিজেপি-তৃণমূল। ১০-১৫ কোটি টাকা আপনারা খরচ করেছেন কেবল সম্মেলন, সেমিনার করে, তার ৫০ শতাংশও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্লান করে খরচ করলে আজ আমরা এরম করুন দশায় থাকতাম না। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক হারে খরচ করতে হবে। ইউ টিউব চ্যানেল, ক্লাউড বেসড ডিজিটাল চ্যানেল, হোয়াটস অ্যাপ প্রোপাগান্ডা মেশিনারি, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং টার্গেটেড ক্যাম্পেন দরকার। সাইবার অ্যান্ড গেন্ডার সেনিসিটিসেশ -এর প্রয়োজন আছে (প্রতি বুথ বা এরিয়া কমিটি স্তরে) পার্সেপশন তৈরি এবং ন্যারেটিভ কন্ট্রোল করতে গেলে। এগুলোকে কর্পোরেট বলে দাগিয়ে দিলে চলবে না। টাকা খরচা করে একটা হাবিজাবি গানের ভিডিও বানানো হয়েছে যা মানুষ দেখেইনি। মোদ্দা কথা ফরম্যাট বদলাতে হবে। যদি পার্টি না টেকে কিসের ফরম্যাট?
৪. প্রোপাগান্ডা তৈরি, ভোটারদের নির্দিষ্ট অংশকে প্রভাবিত করতে নির্দিষ্ট এজেন্ডা ভিত্তিক প্রচার প্রয়োজন। এর জন্য সর্বস্তরের পার্টি কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে থেকে আইডিয়া খুঁজে আনতে হবে। লেজুড় কর্মীদের দিয়ে সেই কাজ না করিয়ে।
৫. সোশ্যাল মিডিয়াতে নেতারা নিজের ইচ্ছেমতো এমন কিছু পোস্ট দিতে পারেন না, যার জন্য কর্মীদের সাধারণ মানুষদের কাছে জবাব দিতে হয়। পোস্ট করার আগে ভাবনা চিন্তা করে পোস্ট করা উচিৎ রাজ্য সম্পাদকের মতো ব্যক্তিকে।
৬. এক্ষুনি যে সকল যোগ্য যুব হোলটাইমার বা পার্টি মেম্বার আছে তাদের নেতৃত্বের আসন দেওয়া হোক। মিডিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ হোক তারা। তল্পিবাহক নয়, যারা সামনে দাঁড়িয়ে গুন্ডাদের সাথে লড়ছে, কেস খেয়েছে তাদের প্রাধান্য দেওয়া হোক।
৭. পার্টির পলিসিগত ভাবে নেতৃত্ব চয়নের সময় কারা লড়াই করেছে, কতবার আক্রান্ত হয়েছে এবং কার প্রতিরোধ গড়তে পেরেছে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। অমুকে আমার বিরুদ্ধ লবি বলেই সে যোগ্য হওয়া সত্বেও তাকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ না করলে পার্টিকে রক্ষা করা যাবে না।
৮.কোন খাতে কত টাকা খরচ হল বুকলেট আকারে ছাপিয়ে পার্টির ব্রাঞ্চ অবধি দিতে হবে।
৯.বিজেপি ও তৃণমূলের সাথে আপোষ করা নেতাদের খুঁজে বের করে পার্টি থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
১০. অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মী-নেতাকে পার্টির ‘মুখ’ হিসেবে টিভি চ্যানেলে পাঠানো বন্ধ করতে হবে।
১১. ‘দাদা’ ‘বাবা’ ধরে কমিটিতে ঢোকা বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। ‘আন্ত পার্টি সংগ্রাম’এর মোড়কে নোঙরা দলবাজির ফলে বহু প্রতিশ্রুতিবান ছেলে মেয়ে বিপথে চালিত হচ্ছে। এই অসুখ একবারে ব্রাঞ্চ স্তর অবধি নেমে গেছে।
১২. অন্তত ৬০ শতাংশ তরুন মুখকে জায়গা দিতে হবে প্রতি স্তরের কমিটিতে।
১৪. বাধা গতের মিটিং মিছিল, পাঠচক্র, ডেপুটেশন, প্রতীকী অনশন, সেমিনারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার অবিলম্বে। তৃণমূল-বিজেপিকে ‘গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল’ পদ্ধতিতে রোখা যাবে না। তরুনদের তুলে আনুন। ওরাই বুঝে নেবে লুম্পনদের। জঙ্গি নেতা চাই। কমরেডদের বজ্যান্ত জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর আপনারা বিকেলবেলা প্রস কন্ফারেন্স করে চলেছেন, ‘আমরা আক্রান্ত, আমাদের মেরেছে,’ মানুষ কেন ভোট দেবে আপনাদের? রাজ্য ব্যাপী ছাত্র-যুবদের শরীর চর্চা/ব্যায়ামের পরিকল্পনা নিতে হবে। খালি তত্ব আউড়ে আরএসএসকে রোখা যাবে না।
১৫. ভোটে লড়তে টাকা ও কৌশল লাগে। সভা করার জন্য বাইরে থেকে বিমান ভাড়া দিয়ে নেতা আনতেই পারেন, কিন্তু তার সঙ্গে বুথস্তরে খাটা কর্মীদের জন্য ব্যবস্থা রাখুন। এমন কাউকে না আনই ভাল যাকে অধিকাংস পার্টি কর্মী,দরদি অপছন্দ করেন। শুধু আবেগ দিয়ে পার্টি হয়না।
১৬.একাধিক সেতু ভাঙা, চাকরির জন্য অনশন, চাকরিপ্রার্থীদের মার, দুর্নীতি। একাধিক ইস্যু থাকা সত্ত্বেও কোনো ধারাবাহিক আন্দোলন নেই, করা হয়নি, গণসংগঠনকেও করতে দেওয়া হয়নি। ছকে বাধা গতের কর্মসূচী। যার কোনো প্রভাব ক্ষতিগ্রস্থ তো দূর, সাধারণ মানুষের মনেও ছাপ ফেলেনি। বাড়ির পর বাড়ি, পার্টি অফিস জ্বালানো হয়েছে, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে কমরেডদের। কী করেছি আমরা? শোক সভা আর কবতা পাঠ। যার ফল এই নির্বাচনে ভুগতে হল।
১৭. আপনারা কথায় কথায় ‘বাজারি মিডিয়া’ বলে চিল্লান। অথচ সবকিছুকে বাজারই নিয়ন্ত্রণ করছে তা কিছুতেই মানবেন না। গণশক্তি তো এমনিতেই কেউ পড়ে না। সেই কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন প্রিন্ট মিডিয়ার যুগ। এখন অডিয়ো-ভিডিয়ো মিডিয়ার যুগ। রাজ্যে অসংখ্য সমর্থক দরদি বারংবার বলা সত্বেও আপনারা কিছুতেই সেই পথে হাঁটবেন না। ফলে আপনাদের কথাও মানুষ শুনবে না। নিজেরাই নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন গোঁয়ারতুমি করে।
১৮. নতুন নেতা নেই। কী করে থাকবে? নতুনদের তুলে আনলে বয়স্কদের চেয়ার চলে যাবে তো। ফলে তরুনদের উঠতে দেওয়া হয়নি। যাদের ওঠানো হয়েছে তারা কোনো না কোনো নেতার তল্পিবাহক। এই রোগ শাখা থেকেই শুরু হয়েছে।
১৯. আপনাদের ভাষা ‘সাধারণ’ মানুষ বুঝতে পারে না। জলপাইগুড়ি চা বাগানে গিয়ে আপনারা পরমাণু চুক্তি বোঝান। আপনারা এখনও ২০০ বছর পেছনে পড়ে আছেন। অথচ যুগ এগিয়ে গেছে। আপনারা মার্কসবাদকে বিজ্ঞান বলেন অথচ আনাদের পার্টি প্রতি পদে সমস্ত অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম অনুসরণ করে চলেছে।
২০. ‘আন্তঃ পার্টি সংগ্রাম’এর নামে বিভিন্নজনে ব্যক্তিগত কথোপকথনের স্ক্রিনশট চালাচালি একটা মহামারির রূপ নিয়েছে। এমনকি ব্যক্তিগত মুহূর্তে ভিডিও পর্যন্ত ফাঁস করানো হয়েছে হানি ট্র্যাপ করিয়ে। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? কমরেডরা কমরেডকে বিশ্বাস করতে পারেনা। ঘরোয়া আড্ডা হলেও সবার কাছ থেকে আগে ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। এ কোন পরিস্থিতি? অথচ আপনারা চাইলেই এইসমস্ত নোংরামি বন্ধ করতে পারতেন। কিন্তু এন্টারটেন করে গেছেন। একজন কমরেডের ব্যক্তিগত মুহূর্তে ছবি, ভিডিও কেন গ্রাহ্য হবে ‘আন্তঃ পার্টি সংগ্রামে’র নামে? যদি তা সহমতের ভিত্তিতে হয়ে থাকে? যদি তা কোনো পদ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে না হয়ে থাকে?’
শুধু তাই নয়, চিঠির শেষাংশে এ-ও বলা হয়েছে, ‘আমরা এটাও জানি এই চিঠির স্থান হবে ডাস্টবিনে। আপনাদের বলে কোনো লাভ হবে না। যেমন চলছিল তেমনই চলবে। কারন ‘নাড়াচাড়া’ করলেই আপনাদের আবার কমিটি হাতছাড়া হবার ভয় আছে। ঘটা করে সম্মেলন হবে। প্যানেল পাল্টা প্যানেল হবে। কমিটিতে ঢোকা নিয়ে অসভ্যতামো হবে। তবুও পার্টিটাকে ভালবাসি বলে একটা শেষ চেষ্টা। এগুলি যদি না করেন, আপনাদের লেভি দেওয়ার লোক থাকবে না কর্মী বিহীন নেতা হয়ে বাঁশ বনের শেয়াল রাজা হয়ে আপনারা থেকে যাবেন, লিভিং ফসিল হিসেবে। এখনও সময় আছে পার্টিটাকে এস ইউ সি করণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবন না। আমাদের কথা শুনুন,লেখাটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিন, নেতারা দেখুক। একটা শেষ ঝাঁকুনি দেওয়া যাক।’
ভোটে ‘গোল্লা’ পাওয়ার পর আলিমুদ্দিনের বাবুদের মুখ পুড়েই ছিল। তার ওপর তাদের কাছে এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার সামিল খোদ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের এই চিঠি। যা নিয়ে বেজায় অস্বস্তিতে ভোট মরশুমে রামের শরণ নেওয়া বাম শিবির।