
বাংলার ভোটযুদ্ধের শুরু থেকেই এবার যাকে বলে, ঘটনার ঘনঘটা। সাতদফা ভোট; নির্বাচনী প্রচারে একটা রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর ১৯বার সফর; প্রতিটি দফায় লাগাতার অশান্তি; ধর্মান্ধ বিজেপির বিভেদপন্থী প্রচার ও সন্ত্রাস; বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা এবং সবশেষে একজিট পোল বিতর্ক। এমন নির্বাচন আমি আমার ৪০বছরের সাংবাদিক জীবনে দেখিনি। বেশিরভাগ একজিট পোলে এবার মোদির জয়জয়াকার। বাংলাতেও বিজেপির চমকপ্রদ বৃদ্ধি দেখাচ্ছেন তারা। অন্য রাজ্যের কী হবে তা নিয়ে কোন মন্তব্য না করে আমি আমার আলোচনা বাংলাতেই সীমাবদ্ধ রাখবো। প্রায় দু-মাস আমি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রচার কভার করার সূত্রে বাংলার প্রতিটি জেলা, প্রায় প্রতিটি জেলা সদর ও রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে ঘুরেছি। তারও আগে কর্মসূত্রে নিয়মিত গিয়েছি রাজ্যের সর্বত্র। বিশেষ করে পাহাড়, জঙ্গল মহল সহ রাজ্যের পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলিতে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বাংলায় বিজেপির ব্যাপক বৃদ্ধির যে ইঙ্গিত একজিট পোল দিয়েছে তা মিলবে না। ধর্মীয় সুড়সুড়ি মার্কা প্রচারের সূত্রে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে বড়জোর দু-একটা আসন বাড়তে পারে তাদের। আমার হিসেবে তৃণমূল পাবে ৩৮টি আসন।
আমি সাধারণ মানুষ কিন্তু কাজের সূত্রে গ্রাম শহর ঘুরে মানুষের চাহিদা ও মেজাজ মর্জি দেখে আমার যা উপলব্ধি হয়েছে তাই স্পষ্টভাবে জানালাম এখানে। এটা কোন ভোট বিশ্লেষণ নয়, আমি সামান্য ফোটোগ্রাফার, আমার তা করার এলেমও নেই। মানুষের প্রতিক্রিয়া, তাদের বলা না বলা কথা, বঞ্চনা ও প্রাপ্তি দেখেশুনে আমি এই সিন্ধান্তে পৌঁছেছি। আমি দেখেছি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় ও মহিলাদের উন্নয়ন ও সুস্থায়ী বিকাশের জন্য যে লাগাতার কর্মসূচী নিয়েছেন তা আগে কখনও ঘটেনি। শুধু শহরের মানুষই নয়, দিদির জনভিত্তি গ্রামের পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মানুষও। তারাই ঝুলি উপুড় করে ভোট দিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়াবেন।
আমি লক্ষ্য করেছি দেশের প্রায় সবকটি বড় রাজনৈতিক দলই এখন চলে কর্পোরেট কায়দায়। কিন্তু টিএমসি দলটি চলে সম্পূর্ণ ঘরোয়াভাবে। আন্তরিকতা, বিশ্বাস, নিষ্ঠা এই দলটির চলার পুঁজি। এ কারণেই রাজ্যে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই দলটির শিকড় ছড়িয়েছে। পিছিয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানোই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তিনি সফল হয়েছেন বলেই সাগর থেকে পাহাড় তার জনসভা, পদযাত্রায় কাতারে কাতারে ভিড় করেছে মানুষ। মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পেরিয়ে এসেছেন তারা শুধু জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ার জন্য, আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। মানুষের এই আবদার মেটাতে সফরে নির্ধারিত সময়সূচীর রদবদল করতে হয়েছে। একজিট পোলের হিসেব তো এসবকিছুকেই মিথ্যা প্রমাণ করে দিচ্ছে। তা কী করে সম্ভব? আমি কি করে ভুলবো শুধু দিদিকে দেখার জন্য বিপজ্জনকভাবে গাছের মগডালে উঠে পড়া কিংবা পিচগলা রাজপথে দিদির পায়ের সামনে শুয়ে পড়া সেসব মানুষগুলিকে। এই ভালোবাসা জননেত্রী অর্জন করেছেন তার কাজের সুবাদে। ভোটের বাক্সে তো তারই প্রতিফলন ঘটবে।
বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর রাজ্য যে এগিয়েছে সেকথা তো কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টেই বলা হয়েছে। বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে রাজ্যের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি। সড়ক থেকে হাসপাতাল, জল থেকে বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য থেকে স্বায়ত্তশাসন সবক্ষেত্রেই অগ্রগতি তো খালি চোখেই দেখা যায়। তৃণমূলের কট্টর সমালোচকরাও এনিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন না। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন কমবে কেন? এর কোন যুক্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ আমি দিনের পর দিন চোখের সামনে দেখেছি গ্রাম শহরের মানুষ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাজকর্মে খুশি হয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। মানুষকে এত অবিশ্বাস আমি করি না, তাই একজিট পোলের রেজাল্ট আমার ভুল মনে হচ্ছে। এই কথাগুলো আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই লিখলাম।
বাংলার ক্ষেত্রে একজিট পোলের হিসেব আমি মানি না। কিন্তু এটাও ঘটনা যে অনেক সম্ভাবনাময় উন্নয়ন প্রকল্পও সঠিক তদারকি এবং নজরদারির ব্যর্থতায় সফল হতে পারেনা। এটা সবসময় সব রাজ্যেই ঘটে। বাংলার উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাণপাত পরিশ্রমের কথা তার বিরোধীরাও স্বীকার করেন। উন্নয়নের সুফল একেবারে নিচের তলায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের জেলায় নিয়ে গেছেন। জেলা পরিষদগুলিকে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। কিন্তু এরপরেও যাদের তিনি যুক্ত করলেন সেই মানুষগুলির কর্মসূচীটি সঠিক রুপায়নের দায় থাকে। কারণ সরকারের প্রধান হলেও রাজ্যটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একা চালান না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তা করা যায় না, প্রশাসনিকভাবেও তা অসম্ভব। বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরের কাজ দেখার জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রীরা রয়েছেন, রয়েছেন জনপ্রতিনিধি এবং আমলারা। তারা যদি নিজেদের করণীয় কাজটা ঠিকমত না করেন তাহলে তার দায়টা সরকারের প্রধানের ওপর চাপানোটা ঠিক নয়। আবার অনেকসময় দলের দুর্বলতা এবং গাছাড়া মনোভাব সরকারের ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলই সরকারের কাজকর্মের দিশা দেখায়। তাছাড়া প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, জনসংযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্বলতা বা ব্যর্থতার জন্য অনেক সম্ভাবনাময় কর্মসূচী ও প্রকল্পের সুবিধার কথা মানুষ জানতে পারেন না এবং বহুক্ষেত্রে প্রকল্পগুলির সুযোগ নিতে ব্যর্থ হন। এসব কারণে ঘটা চাপা অসন্তোষের কারণে যদি আসন সংখ্যা কমে তাহলে তার দায় সরকারের প্রধানের ওপর চাপানোটা অন্যায় হবে, সে দায় কিন্তু সবার। ভোটের ফল নিয়ে দলে নিশ্চয়ই আলোচনা হবে, ফল ভালো হলে হবে উৎসব কিন্তু তার থেকেও জরুরি হল ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।
এবারের ভোটে আমি নিজে এক বিস্ময়কর প্রচারের সাক্ষী। সারাদিনে মাত্র ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে প্রখর রোদে অসংখ্য জনসভার পাশাপাশি মাইলের পর মাইল পদযাত্রা করেছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি তার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, তবুও তিনি থামেন নি এমনকি কাউকে তা জানতেই দেননি। আমাদেরও সেই জেদ আর সাহসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার শক্তি অর্জন করতে হবে। আমি জানি একজিট পোলে বাংলায় তৃণমূল যতগুলো আসন পাবে বলে দেখানো হয়েছে তা মিলবে না। মানুষের রায় উন্নয়নের পক্ষেই থাকবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত