রবিবার সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফার ভোট মিটতেই বিজেপির একাধিক ‘পেইড’ মিডিয়ার তরফে বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। আর প্রায় সমস্ত বুথ ফেরত সমীক্ষাতেই ২৭২ পেরিয়ে গেছে এনডিএ। কেউ কেউ ৩০০, এমনকী ৩৫০-ও পার করিয়ে দিয়েছে মোদী শিবিরকে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, সপা সুপ্রিমো অখিলেশ যাদব থেকে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী, সকলেই একযোগে উড়িয়ে দিয়েছেন এই সকল সমীক্ষাকে। শুধু তাই নয়, বিজেপি নেতারাও এতটা ঠিক হজম করে উঠতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গাডকরির গলায় যেমন সতর্কতার সুর। তেমনি উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু আবার সাফ বলে দিয়েছেন, ১৯৯৯ থেকে বেশির ভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষাই ভুল বলেছে।
প্রসঙ্গত, সমীক্ষার নানাবিধ ফল মিলিয়ে দেখলে ধরা পড়ে, ভুলের ভাগটাই বেশি। যেমন ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এনডিটিভি-এসি নিয়েলসেন সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এনডিএ পাবে ২৩০-২৫০ আসন, কংগ্রেস ১৯০-২০৫, এবং অন্যান্যরা ১০০-২০০ আসন। আজ তক-ওআরজি-মার্গের সমীক্ষা এনডিএ-কে দিয়েছিল ২৪৮, কংগ্রেসকে ১৯০, এবং অন্যান্যদের ১০৫ আসন। আর স্টার নিউজ-সি ভোটার-এর সমীক্ষা বলেছিল, এনডিএ ২৬৩-২৭৫, কংগ্রেস ১৭৪-১৮৬, অন্যান্য ৮৬-৯৮। কিন্তু বাস্তবে এনডিএ ১৮১ (বিজেপি ১৩৮), ইউপিএ ২০৮ (কংগ্রেস ১৪৫), বামফ্রন্ট ৫৯ আসন পেয়েছিল।
আবার ২০০৯-এ সিএনএন-আইবিএন-এর সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এনডিএ ১৬৫-১৮৫, ইউপিএ ১৮৫-২০৫, তৃতীয় ফ্রন্ট ১১০-১৩০, চতুর্থ ফ্রন্ট ২৫-৩৫। স্টার নিউজ-নিয়েলসেন জানিয়েছিল, এনডিএ ১৯৬, ইউপিএ ১৯৯, তৃতীয় ফ্রন্ট ১০০, চতুর্থ ফ্রন্ট ৩৬। ইন্ডিয়া টিভি-সি ভোটার এনডিএকে দিয়েছিল ১৮৩-১৯৫, ইউপিএকে ১৮৯-২০১ এবং তৃতীয় ফ্রন্টকে ১০৫-১২১ আসন। তবে প্রকৃত ফল দাঁড়িয়েছিল, এনডিএ ১৫৯ (বিজেপি ১১৬), ইউপিএ ২৬২ (কংগ্রেস ২০৬), তৃতীয় ফ্রন্ট ৭৯, চতুর্থ ফ্রন্ট ২৭।
এরপর, ২০১৪-এ সিএনএন-আইবিএন-সিএসডিএস-লোকনীতির সমীক্ষা জানিয়েছিল, এনডিএ ২৭৬, ইউপিএ ৯৭, অন্যান্য ১৪৮। ইন্ডিয়া টুডে-সিসেরোর সমীক্ষা বলেছিল, এনডিএ ২৭২, ইউপিএ ১১৫, অন্যান্য ১৫৬। নিউজ ২৪-চাণক্যর সমীক্ষায় দাবি করা হয়, এনডিএ ৩৪০, ইউপিএ ৭০, অন্যান্য ১৩৩। টাইমস নাও-ওআরজি বলেছিল, এনডিএ ২৪৯, ইউপিএ ১৪৮, অন্যান্য ১৪৬। এবিপি নিউজ-নিয়েলসেন বলেছিল, এনডিএ ২৭৪, ইউপিএ ৯৭, অন্যান্য ১৬৫। আর এনডিটিভি-হংস রিসার্চ এনডিএকে ২৭৯, ইউপিএকে ১০৩, এবং অন্যান্যদেএ ১৬১ আসন দেয়। যেখানে প্রকৃত ফল হয়, এনডিএ ৩৩৬ (বিজেপি ২৮২), ইউপিএ ৬৬ (কংগ্রেস ৪৪), তৃতীয় ফ্রন্ট ৭৯, অন্যান্য ১৪৭।
লক্ষণীয়, ২০০৪-এ বুথ ফেরত সমীক্ষা ধরতেই পারেনি, সরকার বদলে যাচ্ছে। ২০০৯-এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ যে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ক্ষমতায় পুনর্বহাল হচ্ছে, তা ধরা পড়েনি। ২০১৪তে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যে ক্ষমতায় আসতে পারে, তা সব সমীক্ষাতেই মোটামুটি ধরা পড়েছে। কিন্তু সেই জয়ের বহরটা কতখানি, বিজেপি যে একাই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেতে চলেছে তা একটি সমীক্ষা ছাড়া কোথাও ধরা পড়েনি। সেই কারণেই এবারের সমীক্ষার ফলকে আমল দিচ্ছে না বিরোধীরা। তারা বলছে, ‘এগজিট পোল’ মোটেই ‘এগজ্যাক্ট পোল’ নয়।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা দেখাচ্ছেন, ইংল্যন্ডের ব্রেক্সিট নির্বাচন বা আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে বুথ–ফেরত সমীক্ষা ব্যর্থ হয়। জার্মানির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এলিজাবেথ নোয়েল নিউম্যানের মতে, সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বাস্তবের গরমিল হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মতদাতাদের জটিল নীরবতা। এই মত অনুযায়ী যদি কেউ মনে করেন তাঁর মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের সঙ্গে মেলে না, তা হলে অধিকাংশ সময়েই প্রকাশ্যে তাঁরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে অনীহা বোধ করেন। এই নীরবতাই সমীক্ষার ফলাফল ও প্রকৃত ফলাফলের মধ্যে ফারাক তৈরি করে।
ফলে বিজেপি নেতা নীতিন গাডকরি অনেকটাই সতর্ক। বলেন, ‘এগজিট পোল চূড়ান্ত ফল নয়।’ কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি টুইটে লেখেন, ‘বিহারের এনডিএ জোট শরিক এলজেপি ৬ আসনে লড়াই করেছে। অথচ প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলের সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ৫-৭টি আসনে জয়ী হবে এলজেপি!’ শশী থারুর বলেছেন, ‘গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার ৫৬টি বিভিন্ন সমীক্ষার ইঙ্গিত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ সমীক্ষকদের সামনে সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পান।’ বিরোধীদের সকলেরই অভিযোগ, বিজেপি ভোটের আগে সংবাদমাধ্যমকে বাধ্য করেছে তাদের হয়ে লিখতে। ভোটের পরেও সমীক্ষার নামে আর এক দফা মিথ্যা প্রচার করানো হচ্ছে।