লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার আগে থেকেই কুকথা ও বিতর্কিত মন্তব্যের ফোয়ারা ছুটছে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে। ভোট ঘোষণা এবং ভোট শুরুর পর তার পরিমাণ আরও বাড়ে। যেমন মালেগাঁও বিস্ফোরণের মতো গুরুতর ঘটনায় অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর প্রার্থী হিসেবে মধ্যপ্রদেশের ভোপালে পা রাখার দিন থেকেই মুখ খুলে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
তিনি বলেছিলেন, ২০০৮ সালে মালেগাঁও বিস্ফোরণের জন্য যখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তখন তিনি তদন্তকারী অফিসার হেমন্ত কারকারেকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, আপনার সর্বনাশ হবে। এজন্য নোটিস পাঠানোর পাশাপাশি তাঁকে নজরবন্দী অব্দি করেছিল নির্বাচন কমিশন। তারপরও গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিতর্ক বাড়িয়েছেন তিনি।
এবার সাধ্বী ইস্যুতে চাপে পড়ে মোদী নিজে জানিয়ে দিলেন, গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য সাধ্বী প্রজ্ঞা ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পরেও তিনি মন থেকে তাঁকে ক্ষমা করতে পারবেন না। বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বললেন, ‘ভোপালে তাঁদের প্রার্থীর মন্তব্যকে দল গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।’ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। সন্ধ্যায় জানান হল কী সেই ‘কঠোর’ ব্যবস্থা।
দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিকে বলা হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ১০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে। ১০ দিন— তার মধ্যে রবিবার শেষ পর্যায়ের ভোট হয়ে যাবে, ২৩ তারিখে ভোটের ফল প্রকাশ হয়ে নতুন সরকারের ছবিও স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এবং নজর থেকে সরে যাবে সব বিতর্ক। স্বভাবতই এই ‘লোকদেখানো ব্যবস্থা’র বিরুদ্ধে সরব হয়েছে কংগ্রেস-সহ বাকি বিরোধীরাও।
তারা বলছে, এই হাস্যকর শাস্তি ঘোষণা প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ আরএসএস-বিজেপি তো নাথুরামের উত্তরাধিকারকেই বয়ে নিয়ে চলেছে। ভোটের মুখে গান্ধীপ্রীতি দেখানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাদের হৃদয়ে যে গডসের বাস, সাধ্বী প্রজ্ঞার মন্তব্যের পর বিজেপির একের পর এক পদাধিকারীর সমর্থন-টুইটই প্রমাণ। উল্লেখ্য, মন্ত্রী অনন্তকুমার হেগড়ে সাধ্বীকে সমর্থন করে লেখেন, ‘৭০ বছর পরে অবশেষে দেশবাসী গডসের সঠিক মূল্যায়ন করছেন। এ জন্য আমি আনন্দিত।’
সাংসদ নলিনকুমার কাটিল আবার রাজীব গান্ধী ও কসাবের সঙ্গে গডসের তুলনা টেনে টুইটে বলেন, ‘গডসে একটা মানুষকে মেরেছিলেন, জঙ্গী কসাব ৭২ জনকে হত্যা করেছে আর রাজীব গান্ধী ১৭,০০০ খুন করেছেন। আপনারাই ঠিক করুন কে বেশি নিষ্ঠুর?’ দলের প্রচার শাখার নেতা অনিল সৌমিত্র আরও এক ধাপ এগিয়ে লেখেন, ‘গান্ধী আসলে পাকিস্তানের জনক। তাঁর মতো লক্ষ লক্ষ লোক দেশে জন্মায়।’
এর পরেই এক দিকে যেমন কংগ্রেস ও অন্য বিরোধী দলগুলি সরব হয়, সমালোচনায় নামেন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ। মহীন্দ্রা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান আনন্দ মহীন্দ্রা টুইটে লেখেন, ‘গোটা বিশ্ব যখন মূল্যবোধের সঙ্কটে, আমাদের দেশ মহাত্মা গান্ধীর দেশ হিসেবে আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে আজও অনুপ্রাণিত করেন বাপু। কিছু বিষয় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে জানতে হয়, না হলে আমরা তালিবান হয়ে উঠব।’
শেষমেশ চাপের মুখে পড়ে এক মন্ত্রী-সহ তিন পদাধিকারীর বিরুদ্ধে ‘শাস্তি’ ঘোষণা করতে হয় শাহকে। তবে সেই শাস্তির বহর নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। মন্ত্রী হেগড়ে এবং সাংসদ কাটিলকে ১০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। দলের চাপে মন্তব্যের দেড় ঘণ্টার মধ্যে সাধ্বীকে নিয়মরক্ষার দুঃখপ্রকাশ করতে হওয়ায় মন্ত্রী ও সাংসদ অবশ্য টুইট সরিয়ে নেন। হেগড়ে যুক্তি দেন, তাঁর অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু অনিল সৌমিত্র টুইট না-সরানোয় তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করেন শাহ। দলের পদ থেকেও সরিয়ে দেন। প্রশ্ন উঠেছে, অনন্ত হেগড়ে মন্ত্রী এবং কাটিল সাংসদ হওয়ার জন্যই কি গুরু পাপে লঘু শাস্তি পেলেন? কংগ্রেস অবশ্য বলছে, ভোটের মুখে লোকদেখানো দুঃখপ্রকাশ ও লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করা হলেও বিজেপি নেতারা এই প্রথম গডসে-প্রেম দেখাচ্ছেন না। উদাহরণ হিসেবে পুরনো একটি টুইটও তুলে এনেছে তারা।