বাবা গোরক্ষনাথের নামে শহরের নাম গোরক্ষপুর। শিলিগুড়িতে পা রাখলে যেমন শোনা যায় ‘দার্জিলিং-গ্যাংটক’, গোরক্ষপুর স্টেশন ছেড়ে বেরোলেও তেমনি কানে আসে ‘সোনাউলি-সোনাউলি’। এটি নেপাল সীমান্ত। আর জায়গাটা বাবা গোরক্ষনাথের নামেই খ্যাত। শিবের শান্ত, স্নিগ্ধ রূপই এখানে আরাধ্য। প্রাচীন কাল থেকে গোরক্ষনাথ মন্দিরের পূজারি ছিলেন নিষাদ। এই পরম্পরা ভেঙে দেন রাজস্থান থেকে আসা ঠাকুর সাধক দিগ্বিজয় নাথ। তিনিই হন পীঠের প্রথম ঠাকুর পূজারি।
১৯৬৭ সালে তিনি নির্দল হিসেবে গোরক্ষপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ধর্ম ও রাজনীতির নিখুঁত পাচনে সেই থেকে সমাজসেবা শুরু। ১৯৭৯ সালে মহন্ত ও সাংসদ হওয়ার সুযোগ নেন অবৈদ্যনাথ। ১৯৮৯ সালে হিন্দু মহাসভায়, ১৯৯১ সালে বিজেপি–তে যোগ দেন। ১৯৯৮–২০১৭ তাঁরই শিষ্য যোগী আদিত্যনাথ একই সঙ্গে দুটি দায়িত্ব সামলেছেন। এখনও যোগী মাঝে মাঝে পুজো করতে যান। এর মাঝে দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার জন্য তাঁর কারাবাসও হয়েছিল।
শুধু গোরক্ষপুরের গোরখনাথ মন্দিরই ৫০ একর জমির ওপর। হরিদ্বার ও অন্যত্র আরও সম্পত্তি আছে। এর ওপর সোনা, হিরে এবং সঞ্চিত অর্থ তো আছেই। ২০১৭–র উপনির্বাচনে যোগীর পছন্দের প্রার্থী প্রবীণ নিষাদের কাছে হেরে যান। যোগী শঙ্কিত হন। এবার কি মহন্তের অধিকারও নিষাদরা দাবি করবে? নিষাদদের সঙ্গে মুসলিম ও দলিত ভোট যুক্ত হলেই মহন্তর অধিকারও হাতছাড়া হবে। প্রাথমিক ভাবে প্রবীণ নিষাদকে হাত করলেও কোনও ঝুঁকি নেননি যোগী। যতই হাত মেলাক, নিষাদ বলে কথা। তাকে কি গোরক্ষপুরে প্রার্থী করা যায়!
এতে নিষাদ নেতা সঞ্জয় ও প্রবীণের ওপর অন্য নিষাদেরা চটেছেন। সেটাকেই কাজে লাগাতে পথে নেমেছেন অখিলেশ যাদব। রামভুয়াল নিষাদকে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি নিষাদ ছাড়াও ঠাকুর, দলিত, যাদব, মুসলিম ভোট পেতে পারেন। তাঁর নির্বাচনী প্রতীকেও সাইকেল আছে। যোগী আদিত্যনাথ বিজেপির টিকিটে দাঁড় করিয়েছেন রবি কৃষণকে। তবে কি রবির ওপর বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটাররা সন্তুষ্ট নন। আসলে ২০১৪ সালে জৌনপুর থেকে এই রবি কৃষণই কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে লড়েছিলেন। এবার বিজেপিতে যোগ দিয়েই গোরক্ষপুরে প্রার্থী।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে নির্বাচন আয়োগকে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা জানিয়েছিলেন, কমার্স গ্র্যাজুয়েট। ৫ বছর বাদে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমে হয়েছে ইন্টারমিডিয়েট। তবে একটা ব্যাপার, ভোজপুরি ভাষা, কাহিনি, গান, চলচ্চিত্রের প্রভাব আছে। তবে সে প্রভাব নস্যাৎ করতে যোগীই যথেষ্ট যোগ্য। বিরোধীদের দরকার নেই। ১৯৬৭ সাল থেকে জায়গাটা গোরক্ষনাথ মন্দির মহন্তের দখলে।
১৯৭৮ সাল থেকে প্রতি বছরই এনসেফেলাইটিস মহামারীর আকার নেয়। বহু শিশু মারা যায়। চিকিৎসার একমাত্র ভরসা বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজ। সেখানে আধুনিক পরিকাঠামো নেই। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথ। ‘আংরেজি দাওয়াসে ইলাজ’ ওদের আসে না। কিন্তু এমার্জেন্সি মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্টে তো সেটাই দরকার। টানা ৫ বছর সাংসদ কোটার টাকা পেয়েও আদিত্যনাথ এই হাসপাতালের আধুনিকীকরণ করাননি।
২০১৭ সালের মে মাসে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। আর আগস্ট মাসেই এনসেফেলাইটিস ভয়াবহ চেহারায় দেখা দেয়। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেনও ছিল না। দিন-রাত পাগলের মতো খেটে বহু শিশুকে বাঁচান ডাঃ কাফিল। তবু ৭০ শিশুর মৃত্যু। হেলিকপ্টারে উড়ে এসে যোগী আধ্যাত্মিক দৃষ্টি মেলে আবিষ্কার করেন সব দোষ ডাঃ কাফিলের। তাঁর অন্তর্ঘাত। সরকারি হিসেবে ৩৬, আসলে ৭০ জন শিশুর মৃত্যুর জন্য কাফিল সাসপেন্ড। তদন্তের নামে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি সঞ্জয় কোহলি তাঁদের অন্তর্বর্তী নির্দেশে, সাসপেনশন পিরিয়ডে ডাঃ কাফিলকে সব রকম সুবিধা দিতে বলেছেন। পূর্ণ বেতন-সহ। আর ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এসব কাফিলের কাছ থেকেই জানা গেল। বলেন, ‘৭ জুনের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করে দিতে বলেছে। এবার নির্বাচনে মোদী, যোগীর বিরুদ্ধে যে কোনও ভাল প্রার্থীর লড়াইয়ে আছি।’
২০০০ সালে এক সাধারণ ঝগড়াকে ঘিরে যোগী এমন উত্তেজক ভাষণ দেন যে গোটা পূর্ব উত্তরপ্রদেশে হিন্দু–মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায়। পরে যোগীকে কারাবাসও করতে হয়। ফলে মুসলমান (সাড়ে তিন লাখ), নিষাদ (৪ লাখ), দলিত (সাড়ে তিন লাখ), যাদব (আড়াই লাখ)— সব ভোট কিন্তু গঠবন্ধন প্রার্থীর দিকে। আখের খেত। মিল বন্ধ। সরকারের ভর্তুকি মিল মালিক পায়, চাষির মাথায় ময়লা কাপড়ের পাগড়ি, চোখে দুরাশা। গোরখপুরে পঞ্চাশ শতাংশ কিসান মোদীর ২ হাজার টাকার ভাতাও পাননি। কংগ্রেসের প্রার্থীর মনোনয়ন বালিয়া ও বাঁশগাঁওতে খারিজ হয়ে গেছে।
মহারাজগঞ্জে মহাজোট প্রার্থী উচ্চ বর্ণের অখিলেশ সিং। অখিলেশ জিতবেন নিঃসন্দেহে। কুশীনগরে দলিত প্রার্থী এনপি কুশওয়া। তাঁকে জিতিয়ে আনতে ভরসা শুধু দলিত, গঠবন্ধন নয়, অন্য ভোটও। কারণ বিজেপির বিজয় দুবে উচ্চ বর্ণের প্রার্থী। কংগ্রেসের আরপিএন সিংহও তাই। ভোট কাটাকাটি হবে সেখানে। উল্লেখ্য, বিজেপি এই সব লোকসভাকে একত্রে নাম দিয়েছে গোরক্ষপুর ক্ষেত্র। মাটির জীর্ণ বাড়ি, ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে প্রধানমন্ত্রী আবাস। আবার স্বচ্ছ ভারতের এমন শৌচালয় যে কেউ প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ভেতরে বসতে পারবে না। এই সব কারিণই ক্ষোভ জমেছে মানুষের, যা গেরুয়া শিবিরের জন্য মোটেই ভাল নয়।