এবারের লোকসভা নির্বাচন যে আর পাঁচটা নির্বাচনের থেকে আলাদা, এ কথা ভোটের আগে থেকেই বলে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এবারের নির্বাচন দেশ গড়ার নির্বাচন। তাই এবার নিজের ভোট যাতে কেউ নষ্ট না করেন, সেউ আবেদন নিয়েই ভোটারদের দোরে দোরে প্রচারে জোর দিচ্ছে তৃণমূল। তাদের এই অভিযানের নিশানায় অবশ্যই বামপন্থী এবং কংগ্রেসের ভোটাররা। মোদী সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বাংলার উন্নয়নকেই অস্ত্র করে ঘরে ঘরে প্রচার চালানোকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে তৃণমূল। নিজেদের ভোট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাম ও কংগ্রেসের ভোট ভাঙিয়ে জোড়া ফুলে টানতে বদ্ধপরিকর তৃণমূল নেতৃত্ব।
রাজ্যে ২০১১ সালে ক্ষমতায় বসার পর বছর দুই ঘুরতে না ঘুরতেই লোকসভা ভোট। সেই ভোটে নরেন্দ্র মোদীর হাওয়া প্রবল হলেও বাংলা যে তাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তা বুঝিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। তাই অন্যত্র দলের জয়জয়কার হলেও এ রাজ্যে দুটি আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে একদিকে যেমন বাংলায় জোরদার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে মমতার প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি সপ্তদশ লোকসভার পটভূমিটাই আমূল বদলে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। স্বভাবতই, মমতাও ইস্তাহার প্রকাশ করে বাংলার এই উন্নয়নের অভিজ্ঞতার নিরিখে দেশ গড়ার ডাক দিয়েছেন।
মমতার দলের জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে যেমন বেড়েছে তেমনই অবক্ষয়ের গ্রাসে পড়েছে বামপন্থীরা। কংগ্রেসের অবস্থাও সঙ্গীন। এই অবস্থায় বিরোধী পরিসরে বিজেপি সিংহভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিজেপির এই ভূমিকার ফলে রাজ্যের ভোট চিত্রে মেরুকরণ ঘটেছে বলে রাজনৈতিক মহলের মত। তাই গত নির্বাচনেও যাঁরা শাসক বিরোধী ছিলেন, তাঁদের ভোট কোন দিকে থাকে, তা এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তৃণমূলের কাছে। সেই বদলে যাওয়া সমীকরণ মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রচারে ওই অংশের ভোটারদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। দেশ গড়ার এই নির্বাচনে তৃণমূলকে না দিয়ে অন্য কোনও দলকে সমর্থন আদতে বিজেপির হাত শক্তিশালী করার নামান্তর, বলছেন মমতা।
মমতার সেই বার্তা নিয়েই তৃণমূল স্তরে ভোটারদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছেন শাসকদলের নেতা-কর্মীরা। বিধায়ক মালা সাহার দাবি, ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পইন’-এ গিয়ে এবারের ভোট যে দেশে সরকার গড়ার ভোট, সেটা বোঝানোর ওপরেই জোর দিচ্ছি। এমনিতেই মোদী সরকারের ওপর মানুষ বিরক্ত। মোদীকে গদিচ্যুত করে দিল্লীতে আগামী সরকার গঠনে তৃণমূল যে মুখ্য ভূমিকা নেবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বামপন্থীরা যদি প্রকৃত মোদী বিরোধী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের তৃণমূলকে সমর্থন করা উচিত, বলছেন তৃণমূলীরা। কলকাতার মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দার মনে করেন, ভোটারদের মধ্যে এমন কোনও পরিবার নেই, যাঁদের এক বা একাধিক সদস্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তৃণমূল প্রশাসনের কোনও না কোনও সামাজিক প্রকল্পে উপকৃত নন।
তাঁর মতে, মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মকাণ্ডই আমাদের প্রচারে বল জুগিয়েছে। তাঁর দাবি, যেসব বাড়ির ভোট বামেদের পক্ষে ছিল, তাঁদের কাছেও এই আবেদন রাখছি। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু মিলিয়ে রাজ্যের মোট ৪৬টি সরকারি প্রকল্প রয়েছে। সিপিএম যে একটিও আসন পাবে না, তা তাদের সমর্থকরাও জেনে গিয়েছেন। তাই ভোট নষ্ট না করে দেশে নতুন সরকার গঠনে অংশ নেওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে, এমনই দাবি স্বপনের। দলের হয়ে যারা রাস্তায় নেমে ভোট পরিচালনা করেন, তাঁদের এই কথায় স্পষ্ট, নিজেদের ভোট বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজেপি বিরোধী সমস্ত ভোট এককাট্টা করতে ঝাঁপাচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরা। এবং এতে কাজও হচ্ছে। কারণ এ হেন প্রচারে অভিভূত সাধারণ মানুষও।