উত্তর কলকাতা তাঁকে একডাকে চেনে। এলাকার যে কোনও সমস্যায় তিনি মানুষের পাশে থাকেন। তিনি সকলের সুদীপদা। উত্তর কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়সকে উপেক্ষা করেই যিনি দিনরাত এক করে প্রচার চালাচ্ছেন। আগামী ১৯ তারিখ শেষ দফার নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলবে উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে। তার আগে শেষ রবিবারে জমজমাট প্রচার চালালেন সুদীপ।
গতকাল মানিকতলা মেন রোডের উপর হুডখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। গাড়ির সামনে তখন হাজারখানেক মানুষের লাইন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে আবার বেলুনের গুচ্ছ। ম্যাটাডোরের উপর চাপানো খানকয়েক পেল্লায় লাউড স্পিকারে তীব্র আওয়াজে গান বাজছে। ভোটের গান। মুঠো মুঠো ফুল উড়ে আসছিল সুদীপবাবুর গায়ে। গাঁদা, রজনীগন্ধার সঙ্গে দোপাটির পাপড়ি। সেই শোভাযাত্রার মাঝেই কেউ একজন আচমকাই একটা মাউথপিস এগিয়ে দিল সুদীপবাবুর দিকে। মাইকে ফুঁ দিতেই গমগম করে উঠল চারদিক। তিনি বললেন, এ তো দেখি ভোটের প্রচার নয়। মনে হচ্ছে বিজয় মিছিলের মুড। সারি সারি মাথা, তাদের কোলাহল, রাস্তার ধার ঘেঁষে উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর রেকাবে চন্দন সাজিয়ে পাড়াতুতো মহিলাদের সুদীপ-বন্দনায় সত্যিই যেন জয়ের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। প্রচারের প্রথম দিন থেকেই এইরকমই জনসমর্থনে ভেসেছেন সুদীপ।
সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হালকা সুগন্ধিতে বেশ ফুরফুরে লাগছিল সুদীপবাবুকে। সাত দফার একবারে শেষ দফার ভোটে তিনি প্রার্থী। দিনের পর দিন সকাল-বিকেল টানা প্রচার, তবু এতটুকু ক্লান্তির ছাপ ফেলেনি তাঁর চেহারায়। এদিনের গন্তব্য ছিল ৩১, ৩২ এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ড। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে উঠে সামান্য কথায় বুঝিয়ে দিলেন তাঁর প্রচারপর্বের রূপরেখা। বললেন, ৬০টি ওয়ার্ড রয়েছে আমার লোকসভা কেন্দ্রে। বৃহস্পতিবারই সবক’টি ওয়ার্ডে প্রচার শেষ করেছি। এখন ফিনিশিং টাচ হিসেবে সামান্য বাকি থেকে যাওয়া এলাকাগুলিতে যাচ্ছি। এরপরই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, বেঙ্গল কেমিক্যালস চলো।
ফুলবাগান থেকে গাড়ি ই এম বাইপাসের দিকে এগতেই সামনে দু’টি ম্যাটাডোর বোঝাই মানুষ দেখা গেল জোড়াফুলের পতাকা হাতে। কিছুটা এগতেই চোখে পড়ল সারি সারি মাথা। তারপরই মাইকে ভেসে এল চিৎকার। জড়ো হওয়া দলীয় কর্মীদের দু’টি লাইনে ভাগ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মাইকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন পৌরপিতা শান্তিরঞ্জন কুণ্ডু। মাইকে তাঁর চিৎকার শুনেই গাড়ির মধ্যে বসে সুদীপ বললেন, এ তো দেখি শান্তি-কণ্ঠ! আহা! শান্তি ভাবতেই পারেনি, এত আগে চলে আসব।
প্রচারের এই জমজমাট মেজাজে আরও একটু উস্কে দিলেন সাধনের স্ত্রী শুক্তি পাণ্ডে। আচমকাই মহিলাদের দলবল নিয়ে তিনি প্রচারের যাত্রাপথে হাজির। বিরাট প্রমীলাবাহিনী নিয়ে তিনি গাড়ির সামনে হাঁটছিলেন সামান্য ধীর গতিতে। তাতেই ক্ষেপে গিয়ে সাধনবাবু বারবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, তুমি সরবে সামনে থেকে? অ্যাই, তোদের বউদিকে সামনে থেকে সরাবি? গাড়ি যাবে কী করে? কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবাই মুচকি মুচকি হাসছিলেন। দাম্পত্যের এমন মধুর পরিণতি উপভোগ করছিলেন সুদীপবাবুও। একসময় শুক্তিদেবী গাড়ির কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বললেন, সুদীপদা, তোমার জন্য বেলের শরবত বানিয়ে এনেছি। খাও। বোতল এগিয়ে দিলেন তিনি। কাঠফাটা রোদ্দুরে তৃষ্ণা মেটাতে ঢকঢক করে সেই শরবত গলায় ঢাললেন সুদীপবাবু।
প্রায় চার ঘণ্টার যাত্রাপথে এতটুকু উৎসাহ হারালেন না মিছিলের কর্মীরা। তীব্র গরমে ঘেমে-নেয়ে গেলেন সুদীপ-সাধন। তবু সামান্য টাল খেল না তাঁদের আন্তরিকতা। একেবারে শেষের দিকে এসে এক অশীতিপর বৃদ্ধা রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত টেনে নিলেন। ঠোঁট ছোঁয়ালেন আঙুলে। স্নেহের চুম্বন শেষে বললেন, জয়ী হও।
পূর্বাশা আবাসনই হোক বা বসাকবাগানের গলি— মালায়-ফুলে ছয়লাপ হল ভোট প্রচারের যাত্রাপথ। তাঁকে ঘিরে মানুষের আবেগকে যতটা সম্ভব সম্মান দিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে যোগ্য সঙ্গত করলেন সাধনবাবুও। কখনও চিরুনিতে চুল আঁচড়ে নিলেন প্রার্থী, কখনও বা সাধন পাণ্ডের ঘেমে যাওয়া মাথা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিল কেউ। জলের বোতল বা ঠাণ্ডা পানীয় গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিলেন অনেকেই। তাতে চুমুকও দিলেন সুদীপ-সাধন। রাস্তার ধারে দাঁড়ানো জনতার ভালোবাসার প্রতিদানে মালা আর ফুল তাঁদের দিকেই ছুঁড়তে লাগলেন দু’জনেই। আবেগে ভাসল প্রচারপথ। পাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল, শুধু ম্যাচ নয়। লিগ জিতব দাদা। জিততেই হবে। সেই আগাম জয়গাথার অনুরণনে যেন গর্জে উঠল গলি থেকে রাজপথ। এগিয়ে চললেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।