তাপ্তি গঙ্গা এক্সপ্রেস। ট্রেম চলেছে বারাণসী থেকে আজমগড়। পথে ঘোষি, জৌনপুর, লালগঞ্জ। ট্রেন আসছে সুরাট থেকে। যাবে ছাপরা। চালু কামরার (জেনারেল) বেশিরভাগ যাত্রীই নবীন যুবক। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, গুজরাটের হীরে ও বস্ত্রশিল্পে কাঁচা শ্রম জোগান দেন। এঁরা তাঁরা। অসুখ হলে, মা মারা গেলেও ছুটি নেই। কিন্তু গুজরাটের নির্বাচনে ২ দিন কারখানা বন্ধ ছিল। বিয়ের লগন, ভোটের তারিখ মিলিয়ে বিনা বেতনের ছুটিতে পশুর মতো ঠাসাঠাসি কামরায় ঘরে ফিরছেন। মোদীর ভারত।
দেবেন্দ্র যাদবের বাড়ি তমসার তীরে কোলবাজ বাহাদুরপুরে। বলেন, ট্রেন ছাড়ার পর অনেকেই কিছু না ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়েছেন। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। তিন হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছেন। জব্বলপুরে একটু হালকা হয়েছিল। অনেকটা ফাঁকা হল কাশীতে। কাশীর পর জৌনপুরের শেষ সীমা পর্যন্ত লাইনের দু’ধারে গম ছাঁটা হলুদ মাঠ। রুক্ষ, শুকনো। বৃষ্টির আগে চাষ নেই। মাঝে গ্রাম। পাঁজর বের করা ইট বা মাটির বাড়ি। পিরামিডের মতো ঘুঁটের স্তূপ। লালগঞ্জের সীমা— মানে আজমগড় জেলা শুরু হয়ে গেল। সবুজ ক্রমশ নিবিড় হচ্ছে।
ট্রেন থামল আজমগড়। গত ৩৫ বছরে আজমগড়ে কোনও না কোনও যাদবই সাংসদ। বিজেপির সবরকম অসহযোগিতা সত্ত্বেও ঘাঘরা (সরযূ) নদীর ওপর ৭টি সেতু করিয়েছেন মুলায়ম। এবার প্রার্থী অখিলেশ বাবার কাজের সুফল তো পাবেনই। আর মানুষ? যাঁকেই ধরুন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটাই কথা— হিসেব কষার দরকার নেই। এখানে সপার যে কোনও প্রার্থীই জিতত। অখিলেশের তো কথাই নেই। উনি সবাইকে নিয়ে চলতে জানেন। আজমগড়েরই এক গ্রাম মুসেপুর। এখানের সব বাড়ি বড়, সুন্দর। কোনওটা সল্টলেক, রাজারহাটকে মনে করিয়ে দেয়।
সরফুদ্দিনপুর আরও সুন্দর। ওখানে তেরাহা (তিন রাস্তার মোড়) ছাড়িয়ে পেট্রোল পাম্প। ওখানেই সপার কার্যালয়। অখিলেশের উজ্জ্বল কাউআউটের পাশে পোস্টার— সাথি-কে ভোট দিন। সাইকেলের ‘সা’, ‘হাতির’ ‘থি’— ‘সাথি’। লোগো— হাতির শুঁড়-সহ মাথা এবং চাকার অর্ধেক নিয়ে পূর্ণচক্র। এখানেই লোহিয়া ভবনে বসে অখিলেশ বললেন, গঠবন্ধন ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তা আর করা যাবে না। মোদীজি তো যা খুশি তাই বলেন। লঙ্কায় গেলে বলতেন, আমিই রাবণকে মেরেছি, আমিই রাম। ধর্ম, পাকিস্তান ছাড়া, গালি দেওয়া ছাড়া ওঁর আর কী বলার আছে!’
মুবারকপুর একটি বিধানসভা কেন্দ্র। বেনারসি শাড়ির বুনকরদের জন্য খ্যাত। মুলায়ম মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়, তাঁতিদের ইলেকট্রিক বিল তাঁতপিছু ১০০ টাকা করে দেন। তার আগে অনেক বেশি দিতে হত। আর বাবরি কাণ্ডের পরও আজমগড়ে ধর্মীয় দাঙ্গা হয়নি। এ জন্য তাঁরা গর্বিত। তাই জোরের সঙ্গে তাঁরা বলেন, মোদী দাঁড়ালেও এখানে হারবেন। আবার নোটবন্দীর সময়ে কানপুরে এক গ্রামবাসীর স্ত্রী লাইনে দাঁড়িয়ে প্রসব করেন। শিশুটির নাম অখিলেশ রেখেছেন ‘খাজাঞ্চি’। ৫ লাখ টাকা মূল্যের মডেল বাড়ি করে দিয়েছেন। বলেছেন, সুযোগ পেলে সব গরিবকে এরকম বাড়ি করে দেবেন। আজমগড়ে দলিত ১৬ শতাংশ, যাদব ১৯ শতাংশ, মুসলিম ১৪ শতাংশ— সবই পাবেন অখিলেশ।
লাগোয়া লোকসভা লালগঞ্জে যাদব ভোটই বেশি। গতবারের সাংসদ নীলম সোনকার (বিজেপি) এবারও প্রার্থী। সংরক্ষিত আসনে নীলম ১৩ এপ্রিল আম্বারির জনসভায় ফাঁকা দর্শকাসন দেখে কেঁদে ফেলেছেন। বসপার সুনীতা আজাদের তাই সম্ভাবনা বেশি। আবার, জৌনপুরের হিন্দি সবচেয়ে শুদ্ধ। যেমন তুরস্কের ফার্সি, শান্তিপুরের বাংলা। জৌনপুর থেকে গোরখপুর, বালিয়ার দিকে গেলে ভোজপুরি মিশে যায়। বিহারে ঢুকলে মগধি, মৈথিলি, ছিকেছাকা মিশে যায়। জৌনপুরের লোক নিজেদের একটু অন্যরকম ভাবেন। সাংসদ কে পি সিংদেও (বিজেপি) এবারেও প্রার্থী। কিন্তু বসপার শামসিং যাদবের জয়ের সম্ভাবনা বেশি।
সবমিলিয়ে বলা যায়, ‘মিলে মুলায়ম-কাঁসিরাম/ হাওয়া মে উড় গয়ে জয় শ্রীরাম।’ পঁচিশ বছর পর ফের অখিলেশ-মায়াবতী এই ‘নারা’র বাস্তব রূপ দিতে চলেছেন উত্তরপ্রদেশে। তফাৎ বলতে মুলায়মের জায়গায় শুধু তাঁর পুত্র অখিলেশ। আর কাঁসিরামের জায়গায় মায়াবতী।