চলতি লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের অন্যতম বর্ষীয়ান প্রার্থী হলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ৭১-এ পা দিয়েছেন সুব্রত। তবে তাঁর এনার্জির কাছে হার মেনেছে বয়সের প্রতিবন্ধকতা। প্রচারের প্রথম দিনে থেকেই যেভাবে, যে উদ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছেছেন তিনি তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
তীব্র রোদকে উপেক্ষা করেই দিনের পর দিন রোড শো, সভা করে চলেছেন সুব্রত। গতকালের ওই রেকর্ড গরমেও তিনি প্রচার বাদ দেননি। গতকাল শ্যামাপুর গ্রামে গাড়ি ঢুকতেই এক প্রৌঢ় ‘সুব্রতদা, সুব্রতদা’ করে ছুটে এসে হাত মিলিয়ে গেলেন। রাস্তার দু’ধারে নিজের নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়া, মধ্যবয়স্কা, তরুণীরা কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করছেন তৃণমূল প্রার্থীকে দেখে। নামো মেজিয়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা মনোরঞ্জন ঘোষ নমস্কার করে বললেন, ‘দাদা, আমাকে মনে আছে তো!’
ওই গ্রামের রাস্তায় তাঁকে দেখতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের উদ্দেশে সুব্রতর প্রশ্ন, ‘কী, জল আসছে তো ঠিকঠাক?’ দু’জন মহিলা হাসিমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনিই তো এনে দিলেন।’ পরিতৃপ্ত সুব্রত বললেন, ‘জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তরের মন্ত্রী থাকার সময়ে এই সব প্রত্যন্ত গ্রামেও পাইপলাইনে জল এনেছি ২০১৬-তে। স্বাধীনতার ৭০ বছর এমন কাজ হল। সেই জন্য বাঁকুড়ার বহু গ্রামের মানুষ আমাকে বলছে, আপনি তো ভগীরথ!’
মেজিয়া বাজারে এক প্রৌঢ় তৃণমূল নেতাদের বলেছিলেন, ‘মানুষটার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর কী দেব! একটা ছাতা এনে দিই?’ ধন্যবাদ জানিয়ে হাসিমুখে তাঁকে মানা করেন সুব্রত। আগের দিনই তালড্যাংলা-সিমলাপালে প্রায় ১১ ঘণ্টা প্রচার করেছেন বর্ষীয়ান এই মন্ত্রী। তার পর দিন সকাল ১০টার একটু পরে মেজিয়ায় প্রচার শুরু। হুডখোলা গাড়িতে তিনি ওঠার সঙ্গে তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা বললেন, ‘দাদার একটা ছাতা লাগবে তো!’ সুব্রত হাত নেড়ে বলেন, ‘না, না ছাতা নিই না।’ অথচ নিজেই বললেন, ‘কলকাতায় দাঁড়ানো আর এখানে দাঁড়ানোর তফাত বুঝতে পারছ? চার দিকে রুক্ষ্ম প্রান্তর। আর মাথার উপর সূর্য জ্বলছে।’ সুব্রতর ছায়াসঙ্গী তথা পারিবারিক বন্ধু স্বপন মহাপাত্রের ব্যাখ্যা, ‘মুখ ঢেকে যাবে বলে উনি ছাতা আর টুপি ব্যবহার করেন না। ওঁর মুখটা তো খুব পরিচিত।’
মেজিয়া অঞ্চল ছেড়ে কুসতোড় অঞ্চলের কাঁসাই গ্রামে ঢুকতেই রজনীগন্ধা ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হল সুব্রতর গলায়। সঙ্গে গাঁদা ফুলের পাঁপড়ির বৃষ্টি। তৃণমূল প্রার্থীকে এক যুবক খাইয়ে দিলেন কালাকাঁদ, হাতে ধরিয়ে দিলেন নরম পানীয় ও ঠান্ডা জলের বোতল। কানসাড়া গ্রামের ভচটাযপাড়ায় সুব্রত ঢুকতে রীতিমতো উচ্ছ্বাস। পুষ্পবৃষ্টি তো আছেই, সেই সঙ্গে এক তরুণী কপালে ফোঁটা দিলেন পোড় খাওয়া এই রাজনীতিককে। গাড়ি আবার ধরল মেজিয়া অঞ্চলের পথ। তারাপুর গ্রামের পালপাড়ায় এক মহিলা নুন-চিনির ঠান্ডা সরবতের বোতল হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই গরমে এটা খান। সুস্থ থাকবেন।’
তখন দুপুর ১২টা বেজে ২০ মিনিট। কালো হুডখোলা গাড়িতে বিনা ছাতা-টুপি-সানগ্লাসে বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীর ততক্ষণে সওয়া দু’ঘণ্টা প্রচার হয়ে গিয়েছে। ‘কভার’ করা হয়ে গিয়েছে মেজিয়া ও কুসতোড় অঞ্চলের বেশির ভাগ গ্রাম। যে দিনের কথা, সে দিন ফণীর প্রভাবের কোনও ব্যাপার ছিল না। সকাল ৯টা বাজতে না বাজতেই সূর্যের অগ্নিবাণ নিক্ষেপ শুরু হয়েছে রানিগঞ্জ ঘেঁষা বাকুড়ার এই তল্লাটে। সেই পরিবেশে টানা দহন মাথায় করে অক্লান্ত প্রচার তৃণমূল প্রার্থীর।
মোক্ষম প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত শালতোড়ার তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বাউরিই করলেন। আশপাশে থাকা দলের বাকি দু’-তিন জন নেতার মনেও একই কৌতূহল জমা। তবে প্রশ্নটা বেরোল স্বপনের মুখ থেকেই, ‘দাদা, কী খেয়েছেন, বলুন তো? আপনার এনার্জি দেখছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই ভয়ঙ্কর রোদও আপনাকে কাবু করতে পারছে না!’ সুব্রত মুখোপাধ্যায় হেসে জবাব দিলেন, ‘প্রার্থী হয়েছি। এনার্জি না থাকলে চলবে!’
কী খাচ্ছেন সেটা অবশ্য ব্যাপার নয়। ভোটের সময়ে নেতাদের এনার্জি এমনিতেই বেড়ে যায়। কিন্তু এই বয়সেও যেভাবে প্রচার করছেন তিনি তাঁর কাছে হার মানবেন অনেকেই। গাড়িতে থাকা তাঁর সঙ্গীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন এই তীব্র গরমে তবে ক্লান্তি যেন হার মেনেছে তাঁর কাছে। তাই কখনও চালকের বাঁ পাশে বসা, বেশির ভাগ সময়ে সিটে উঠে দাঁড়ানো তিনি, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত অবিচল, অনমনীয়, অদম্য। মুখে ক্লান্তি ও পরিশ্রমের লেশ টুকুও দেখা যাচ্ছে না। কোনও এনার্জি ড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারেন অনায়াসে!