মেগান মার্কেলের বিয়ের ওড়নায় কমনওয়েলথের ৫৩টি দেশের গাছগাছালির নকশা নজর কেড়েছে সকলের। তবে কেউ কেউ এই ভেলটির ডিজাইনে আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উদ্ধত প্রতিনিধিত্বের ছায়া লক্ষ্য করেছেন। এই ৫৩টি দেশ একটা সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। একটু অন্যভাবে হলেও কি আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া হলনা ঔপনিবেশিক শাসনের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস?
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এখন ইতিহাস। কিন্তু নিরুচ্চারে তাকে সমর্থন করার সুযোগ পেলে, তা মোটেই হাতছাড়া করেনা ব্রিটিশ রাজ পরিবার।এমনকি সেটা বিয়ের মত একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেও।
চলতি মাসের ২০ তারিখে রাজকীয় রীতিনীতি মেনেই বিয়ে সারলেন রাজকুমার হ্যারি এবং অভিনেত্রী মেগান মার্কেল। বিয়ের পর মেগান অবশ্য এখন ডাচেস অফ সাসেক্স। স্বাভাবিক ভাবেই মেগানের বিয়ের পোশাকের ডিজাইন কেমন হবে, তাই নিয়ে একটা আগ্রহ সবার মধ্যেই ছিল।
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজ পরিবারের এই নতুন বধূর কনে সাজটি সবারই বেশ মনের মতোই হয়েছে।
সিদেসাধা কিন্তু আভিজাত্যপূর্ণ, দুধসাদা এই পোশাকটি ফরাসী ফ্যাশন ব্র্যান্ড জিভঞ্চি-র। পোশাকটি ডিজাইন করেছেন এই বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডের প্রথম মহিলা ডিজাইনার ক্লেয়ার ওয়েট কেলার। মেগানের এই পোশাকটি ডিজাইনের সুবাদে ব্রিটিশ এই ডিজাইনার এখন ফ্যাশন দুনিয়ার খবরের শিরোনামে। বিয়ের পর রাজকুমার হ্যারি তাঁর স্ত্রীর জন্য এতো সুন্দর একটা পোশাক ডিজাইন করার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন এই ডিজাইনারকে।
এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল।
তবে মেগানের এই পোশাকটি নিয়েই কিছু প্রশ্ন উঠেছে বিদ্বজনদের মনে। তাঁর মধ্যে একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম কলেজের ইতিহাসবিদ অপর্ণা কাপাডিয়া।সাম্প্রতিক scroll.in-এ প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায়, মেগানের বিয়ের পোশাকটির প্রসঙ্গে তিনি ফিরে গেছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একদম গোড়ার দিকে। বিয়ের দিন মেগান যে ভেলটি দিয়ে মাথা ঢেকেছিলেন, তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অপর্ণা।
প্রায় সাড়ে ষোল ফুট লম্বা এই ভেলটিতে, হাতে এমব্রয়ডারি করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কমনওয়েলথের ৫৩টি দেশের গাছগাছালির নকশা। হাতে তৈরি এই ভেলটি বেছে নেওয়ায় মেগান প্রচারমাধ্যমের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। বলা হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই নতুন সদস্য এর মাধ্যমে তাঁর নারীবাদী স্বাধীন চিন্তাভাবনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।রূপকথার রাজকুমারীর মতো রাজকীয় আড়ম্বরে ভেসে যাননি তিনি।
তবে যে হাতের কাজ নিয়ে এত তারিফ হচ্ছে তা এক রকমের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতোই। কমনওয়েলথ দেশগুলির মধ্যে বৃহত্তম ভারত হল এক অন্যতম স্বাক্ষী এই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের। অপর্ণা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এই উপমহাদেশেরই হাতে বোনা কাপড়, ইংল্যান্ডে দারুণ জনপ্রিয় ছিলো। প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো সেইসব কাপড়ে সেজে উঠতো তাদের অভিজাত অন্দরমহল। শুধু তাই নয়, তা দিয়ে তৈরি হতো ফ্যাশনেবল পোশাকও।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একসময় আইন করে সব ধরনের ভারতীয় বস্ত্র ইংল্যান্ডে আমদানি করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। কারন ভারতীয় বস্ত্রের এই বিপুল জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিলেন না ইংল্যান্ডের বস্ত্র ব্যাবসায়ীরা। এই আইনের ফলে ভারতে দেশি বস্ত্র তৈরির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়েন তাঁরা। প্রায় ধ্বংসের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় বস্ত্রশিল্প।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চিত্রটা বদলায়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গান্ধীজির চরকা আন্দোলনের সূত্রপাত। মেগান মার্কেলের ভেলের ডিজাইন এই অন্ধকার ইতিহাসকে খানিক আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন এই ইতিহাসবিদ।
অপর্ণার অভিমত, মেগানের এই বিয়ের পোষাকে যতখানি ডিজাইনারের সৃজনশীলতার পরিচয় আছে, তার থেকেও বেশি আছে মেগানের সচেতন পরিকল্পনা। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিয়ের পর হ্যারি এবং মেগানকে কাজ করতে হবে এই কমনওয়েলথ দেশগুলোতেই। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই দেশগুলিকে আগে থেকে সেই বার্তা দেওয়ার প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা। আর ব্রিটিশ মিডিয়া ও নাগরিকদের বৃহদাংশও এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে গিয়েছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
( মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )