২০শে মে ২০১৮। রবিবার। রাত্তিরবেলা নেমেছি বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে। সংসদীয় যৌথ কমিটির মিটিংএ যোগ দিতে। গাড়িতে উঠে হোটেলের দিকে রওনা হবার লম্বা পথে সহযাত্রী গাড়ির চালক ও প্রোটোকল অফিসারের সাথে গল্প শুরু হয়েছে । কর্ণাটকে সদ্য মেটা ভোট ও তার পরবর্তীতে রাজনীতি আলোচনায় ঢুকে পড়েছে। হটাৎ আমার গাড়ির চালক বন্ধু আমায় বললেন তিনি শুনেছেন যে কর্ণাটকের রাজভবন নাকি বানিয়েছিলেন ঘোড়া ব্যবসায়ী আগা আলী আসকার। বললেন তার প্রাত্যহিক আড্ডার বন্ধুদের থেকে তিনি এটা শুনেছেন। আসলে এই আগা আলি আসকার দের প্রসঙ্গ হটাৎ কেন উঠে আসছে তা নতুন করে বলবার প্রয়োজন পরেনা।
মোদি সরকার ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন রাজভবনে রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত হতে থাকেন বিজেপি-আরএসএস এর নেতারা । এদের মধ্যে কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদেরকে গর্বিত ‘সঙঘী’ হিসাবেও তুলে ধরতে থাকেন অবিরত। গোয়া, মনিপুর ও মেঘালয়ে নির্বাচন পরবর্তীতে তৈরি হয় বিতর্ক। গোয়াতে কংগ্রেস (১৭টি আসন) কে টপকে ডাক পায় বিজেপি (১৩টি আসন) । মণিপুরেও এক ছবি । কংগ্রেস (২৮টি আসন) এর বদলে ডাক পায় বিজেপি (২১আসন) । মেঘালয়তে মাত্র দুটি আসন পাওয়া বিজেপি সরকার গঠনে নেতৃত্বে দেয়।
কর্ণাটক নির্বাচনের পর ও একই ছবি । জেডিএস-কংগ্রেস রাজ্যপালকে ১১৭ জন বিধায়কের তালিকা দেওয়ার পরও ডাক পান ইয়েদুরাপ্পা। ১০৪ জন বিধায়কের সমর্থনে তৈরি হওয়া বিজেপি সরকার সাত দিন সময় চায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমানের জন্য। প্রাক্তন বিজেপি নেতা কর্ণাটকের রাজ্যপাল বাজুভাই ভালা ইয়েদুরাপ্পাকে দেন আরো বাড়তি ৮ দিন। ১৫ দিনের সময়সীমাকে খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট । আস্থা ভোটে অংশ নেওয়ার আগেই রণে ভঙ্গ দেয় বিজেপি । ইস্তফা দেন ইয়েদুরাপ্পা।
কুমারস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিজেপি বিরোধী শক্তির বিন্যাস নতুন মাত্রা পেয়েছে । শপথ গ্রহণে উপস্থিত থাকছেন প্রায় সব আঞ্চলিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মায়াবতী। অখিলেশ যাদব থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে চন্দ্রশেখর রাও। শারদ পাওয়ার থেকে এম কে স্টালিন। উপস্থিত থাকবেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী। লালুপ্রসাদ যাদব ও বিজু পট্টনায়ক এর প্রতিনিধি থেকে বাম নেতারা।
আসলে কর্ণাটক দেশের রাজনীতিতে অনেক গুলো নতুন উপাদান যোগ করেছে। একের পর এক রাজ্যে যেনতেন প্রকারেণ বিজেপির সরকার গড়বার অশ্বমেধের ঘোড়ায় লাগাম দিয়ে দিয়েছে কর্ণাটক। এই আত্মবিশ্বাস ও বোধের জন্ম হয়েছে- ঐক্যবদ্ধ হলে বিজেপিকে হারানো সম্ভব। গত এক সপ্তাহের কর্ণাটক এই সম্ভাবনার সামনে দেশকে দাড় করিয়েছে যে মোদি-অমিত শাহ জুটি কে শুধু ঠেকানো নয়; হারানোও সম্ভব।
কর্ণাটক আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলাকে। বিজেপি কে রুখতে গেলে “একের বিরুদ্ধে এক ” ফর্মুলার কথা বারবার বলছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। কর্ণাটকে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কংগ্রেস এবং কুমারস্বামী সরকার গড়তে চেয়ে রাজ্যপালের কাছে দাবি জানিয়েও ডাক পাননি।
ঘোড়া কেনাবেচার আসরে নেমে পড়েছিল বিজেপি। ঘোড়া কেনাবেচার ব্যাপারে বিজেপির পারদর্শিতা এতটাই যে কেউ হলফ করে বলতে পারছিলেন না যে যৌথ সংখ্যা থাকা সত্বেও কংগ্রেস- জেডিএস সরকার গড়তে পারবে কিনা?
অথচ এই অবস্থা আসতই না যদি নির্বাচনের আগেই জেডিএস এর সঙ্গে আসন সমঝোতায় রাজী হতেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। কর্ণাটক নির্বাচনের আগেই জেডিএস এর সঙ্গে রফা করুক কংগ্রেস- এই কথা বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু জেডিএস এর সঙ্গে সমঝোতা না করে তাদেরকে বিজেপির “বি- টিম” আখ্যা দিয়ে দেন রাহুল গান্ধী। ভোটের ফল বেরোবার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত পথটাই নিতে হয়েছে কংগ্রেসকে। জেডিএস কে নি:শর্ত সমর্থনের কথা ঘোষণা করতে হয়েছে দশ জনপথকে। এইচ. ডি. দেবগৌড়া যখন বিএসপি’র সাথে আঁতাত করছেন তখনও কংগ্রেস কোনো আগ্রহ দেখায়নি । বিএসপি সুপ্রিমো মায়াবতী কিন্তু একেবারে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন | কিন্তু কংগ্রেস সাড়া দেয়নি। ভোটের ফল বেরোবার পর ইগো ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে কংগ্রেসকে বাধ্য হয়েই ।
কর্ণাটকের ফলাফল একটা বাস্তবতাকে দিনের আলোর মতন পরিষ্কার করে দিয়েছে। বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই এক ছাতার তলায় আসতে হবে। কংগ্রেসকে “দাদাগিরি’র” মানসিকতা ছাড়তে হবে । বিজেপি বিরোধী মঞ্চে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই দিতে হবে সমান মর্যাদা। রাহুল গান্ধীকে বুঝতে হবে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে ইগোর কোনো জায়গা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “একের বিরুদ্ধে এক” ফর্মুলা যদি এক্ষুণি রাহুল মেনে নেন তাহলেই সামনের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়া যাবে।
একটার পর একটা লোকসভা উপনির্বাচনের ফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মোদি বিরোধী লড়াইয়ের ঐক্যবদ্ধ চেহারা। পার্থক্য ভুলে এক হয়েছেন বুয়া-ভাতিজা। উত্তরপ্রদেশে। অখিলেশ মায়াবতীর জোট কেড়ে নিয়েছে ফুলপুর। গোরক্ষপুরের মতো কেন্দ্রে হারতে হয়েছে বিজেপিকে। প্রায় তিন দশক বাদে। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়। রাজস্থান থেকে পাঞ্জাব। মধ্যপ্রদেশ থেকে উড়িষ্যা। সর্বত্র একই ছবি। যে যেখানে শক্তিশালী বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের সেই মুখ ।
রাজস্থান, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, গুজরাট- বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি কংগ্রেস। অন্যদিকে উড়িষ্যাতে বিজেডি, তামিলনাড়ু তে ডিএমকে, অন্ধ্রে টিডিপি, ওয়াই এস আর, তেলেঙ্গানায় টি আর এস, বিহারে আর জে ডি, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী ও বহুজন সমাজ পার্টি, মহারাষ্ট্রে এনসিপি এবং বাংলায় টিএমসি- বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধানতম মুখ। এটাই আজকের বাস্তবতা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আর শুধু বাংলার নেত্রী নন – তাকে কেন্দ্র করে দেশের বিজেপি বিরোধী রাজনীতি উত্তাল ও আলোড়িত হচ্ছে তা কংগ্রেস থেকে সিপিএম – সবাইকেই উপলব্ধি করতে হবে । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গত সংসদ অধিবেশনের সময় দিল্লী সফর যে শুধু বিজেপির রক্তচাপ বাড়িয়েছে তা নয় । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে সংসদ ভবনে বিজেপি বিরোধী সাংসদদের উন্মাদনা রাহুল গান্ধী, সূর্য মিশ্রদের সংসদের প্রতিনিধিরাও দেখেছেন – সংসদের সেন্ট্রাল হলে। বিজেপি বিরোধী ঐক্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রাণকেন্দ্র।
কর্ণাটকের নির্বাচন আরও একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে । দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষের মন বোঝেননা । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ঘিরেই বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দল গুলোর ঐক্য দানা বাঁধছে | বাস্তব রূপ নিচ্ছে। কর্ণাটকের নির্বাচন পরিস্কার ভাবে বুঝিয়ে দিলো যে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “একের বিরুদ্ধে এক” লড়াইয়ের ফর্মুলাই এক মাত্র রাস্তা।
সময়ের আহবান তাই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনোরকম শিথিলতা চলবে না। যে কোনো অবস্থাতেই নিশ্চিত করতে হবে একের বিরুদ্ধে একের লড়াই। ধর্মনিরপেক্ষতা বিপদের মুখে । দেশের সংবিধান সুরক্ষিত নয়।সভ্যতার ধাত্রীর গলিত গর্ভের আবহমান কালের অপরাজিত ভারতীয় বহুত্ববাদ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সংস্থা গুলোর ভীত নড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের জীবন জীবিকায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মোদি সরকার। লালন-কবীরের পরমত সহিষ্ণুতার ভারতবর্ষ রোজ উচ্চারণে বাধ্য – ‘ এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা’ । তাই প্রয়োজনে কাউকে কাউকে নীলকন্ঠ হতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থেই। কর্ণাটকের শপথ গ্রহণের মঞ্চ থেকেই ভেরী বাজুক। লেখা হোক দেওয়াল- চাই একের বিরুদ্ধে এক। দেশ ও দশের স্বার্থে।
( কৃতজ্ঞতা: আজকাল )