যিনি ভিডিও করেছেন তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি, বাংলাভাষা আন্দোলনকারী। গর্গ চট্টোপাধ্যায়। যিনি তর্ক করছেন তিনি হিন্দিভাষী। ছোটবেলা থেকে তাঁকে শেখানো হয়েছে এই দেশের নাম হিন্দুস্থান।
এ দেশের একটা রাষ্ট্রীয় ভাষা আছে -তা হল হিন্দি। এখানে হিন্দি ছাড়া হাতে গোনা কিছু প্রান্তিক ভাষা আছে যা গৌণ, এখানে হিন্দিতেই কথা বলা দস্তুর। ওঁকে বোঝানো হয়েছে, আগে এখানে হিন্দুরা থাকতো, রাজার নাম ছিল রাম, সংখ্যালঘুরা শত্রু। এর বাইরে কিছু হতে পারে না। বেচারা পড়েছে বাঙালির কবলে। হলদে সবুজ ওরাংওটাং করে ছেড়েছে!
জেনে রাখুন, দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এখানে হিন্দি ছাড়াও আরো ৩০টা ভাষায় কথা বলা হয়। এ ছাড়াও আছে অনেক আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি। এরকম একটা দেশে হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান আরোপ করতে চাইছে কেউ কেউ নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ফায়দার জন্যে।
এই গোটা ভূ-ভারতে অন্য কোন জায়গায় কখনো কোন পাগড়ি পড়া চাপ-দাড়ি সর্দারজীকে দেখেছেন চোস্ত বাংলায় বিক্রিবাটা করতে? তৃপ্তি করে পাঁচফোড়ন দেওয়া ডাল, ধোকার ডালনা, বড়ি দিয়ে সজনেডাঁটা খেতে? আমি দেখেছি। ভবানীপুর, হাজরা, লোয়ার সার্কুলার রোডে।
কোথাও দেখেছেন তামিলভাষী মানুষেদের দিব্যি লেক মার্কেটের রাস্তা দিয়ে হাঁটু অবধি সাদা লুঙি (ভেস্তি ও মুন্ড) পড়ে সকালে ইংলিশ খবরের কাগজ কিনতে আর ফিল্টার চা খেতে বেরোনো? তাদের মনে কান পাতলে শুনবেন তারা এই বাংলাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চান। ত্যাগরাজ হলে স্মরণ সভায় যে ইডলি হবে, তাও ঠিক করা। প্রাণের বন্ধু মুখার্জীদাকে মনের কথাও বলে গেছেন। বউদির হাতের ছানার ডালনা আইয়ার আন্নার বড্ড ভালো লাগতো। বউদিও ওতে অকারণ কারিপাতা দিতেন আন্না খাবে বলে।
আমি দেখেছি।
কোন মহানগরে দেখেছেন চিনে পাড়ার নির্ঝঞ্ঝাট মিস্টার লি-কে বড়বাজারের ‘ব’ এ বেওসা করা ঝুনঝুনওয়ালাজীর সাথে দরদাম করতে? বা চিনে কালী মন্দিরে চাউমিন প্রসাদ বিতরণ করতে তিলজলার কোন বাঙালি কায়স্থকে?
আচ্ছা এন্টনি ফিরিঙ্গী নামের কোন কবিয়ালকে অন্য কোন প্রদেশে পাবেন?
বাংলাভাষায় কুরান শরীফের অনুবাদ করেছিলেন গিরীশচন্দ্র সেন- একজন হিন্দু। আবার এখানেই রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ ছুঁয়ে গেছিলেন প্রাণ। ব্রাহ্মসমাজের বিস্তার করেছিলেন রামমোহন রায়, বৈষ্ণবমত প্রচার করেছিলেন চৈতন্যদেব। শাহ জালাল শুনিয়েছিলেন সুফির মাহাত্ম্য। দামাল ছেলেদের নিয়ে গোঁড়ামির বিরুদ্ধাচার করেছিলেন ডিরোজিও।
এই শহরটা এই সব ক’টা মানুষের -যারা জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও বাংলার মাটি, জল, বায়ু, আগলে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন বাংলা ভালোবেসে।
এই শহরে বাংলাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বাংলা সাইনবোর্ড, বাংলায় মাইলফলক, বাংলায় পরিষেবা দেবে লোকে।ইংরাজি বা হিন্দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাটা শিখুন। স্বছন্দ্য বোধ করুন বাংলায় কথা বলতে, এই বাংলায় থাকলে।
মারাত্মক এক ষড়যন্ত্র চলছে। দুর্ধর্ষ দুশমন। মগনলাল মেঘরাজ, জুমলাম্যান, দাঙ্গাম্যান, ফেকনিউজম্যান আর হনুম্যানকে নিয়ে রেডি বাংলায় সাবরিনা আর সহেলীর একসাথে ফুচকা খাওয়ার প্ল্যান ছত্রভঙ্গ করতে। হেক্টর, হর্ষ আর হায়দারের এক গেলাসি বন্ধুত্ব ভাঙতে, ক্যারামের বোর্ড লণ্ডভণ্ড করতে, জোড় করে হিন্দি আরোপ করতে।
ফেলুদা, বোমক্যেশ, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, র্যাক্সিট, মিতিন মাসিকে একজোট হতে হবে। হবেই। হোক গে হাঁসজারু, কিন্তু ভিলেন রান্নাঘর অবধি চলে এসেছে। কি সাহস ফ্রিজ খুলে কোন মাংস রাখা চেক করছে। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। দরকার হলে অগা প্রখর রুদ্রকেও টিমে চাই। হারবার্টকেও। যতই অতি বিপ্লবী হোক ও। ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম দ্রাম্ -লড়াই করতে হবে।
ময়ূখ আজও বিশ্বাস করে বাঙালিদের অসীম ক্ষমতা। খালি ভাত-ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। বাঙালি বোরোলিন আর জেলুসিল নিয়ে, পরীক্ষার আগে মায়ের দেওয়া দই-এর টিপ পরে মঙ্গল গ্রহও জয় করতে পারে। আর এত বদ সাম্প্রদায়িকাসুরকে বধ করতে পারবে না বহুত্ববাদী পশ্চিমবঙ্গবাসী?
( মতামত ব্যক্তিগত )
( লেখক একটি সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কর্মরত )