গত ১১ এপ্রিল থেকে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন। সাত দফা ভোটের মধ্যে ইতিমধ্যেই সাঙ্গ হয়ে গেছে তিন দফার ভোট। তবে দেশের কোনও প্রান্তে এবার মোদী লহর তো নেই-ই, তার মধ্যে আরাবল্লি পাহাড়ে ঘেরা মেবার বংশের রানাদের হাতে তৈরি ‘সিটি অফ লেক’ রাজস্থানের উদয়পুর ঘিরে এবার লোকসভা ভোটে নতুন ব্যতিক্রমী সমীকরণ তৈরি হওয়ায় সে রাজ্যে বেশ ভাল মতোই চাপে বিজেপি।
অনেকটা ১৫৭৬ সালে মেবারের রানাপ্রতাপের সেই বিখ্যাত হলদিঘাটের যুদ্ধের ধাঁচে দীর্ঘদিনের গেরুয়া ঘাঁটি ভেঙে এবার তেরঙার দাপট লক্ষ্য করছি শহরের প্রাসাদের অন্তঃপুরেও। পিছোলা বা ফতেসাগর লেকের পাড়ে কান পাতলে ঘুঙুরের শব্দ শোনা না গেলেও জোরাল গলার ভোটের স্লোগান ভেসে আসছে। সিটি প্যালেস, লেক প্যালেস থেকে শুরু করে জগমন্দির, লক্ষ্মীবিলাস, সর্বত্র ক্ষত্রিয়-জাঠ-চামার সব সম্প্রদায়ের মুখে আলোচ্য বিষয় একটাই ‘ইসবার কাঠে-কপাটে ফাইট’।
রাজপথে, রাস্তার মোড়ে বিশাল বিশাল হোর্ডিংয়ে কংগ্রেস সভাপতির ছবি। পাল্টা প্রধানমন্ত্রীর ‘ফির একবার’ একটু যেন পিছিয়ে পড়েছে। আসলে চারমাস আগের ভোটে কৃষকদের ভোটে ক্ষমতায় আসা কংগ্রেস রাজস্থান থেকেই পদ্মশিবিরকে পিছনে ফেলতে চাইছে। কিন্তু গতবার রাজস্থানের সমস্ত আসন, ২৫-০ ফল করে জেতা বিজেপি কিছুতেই একটি আসনও হারাতে চাইছে না।
লড়াই যে জোর জমেছে, সিটি নিয়ে কাড়াকাড়ি অশান্তির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে–তার প্রমাণ প্রতিবেশী গুজরাতে। সেখানে ২৬ আসনে এক দফায় ভোট হল। কিন্তু কংগ্রেস শাসিত রাজস্থানে ২৫টি আসন হলেও দু’দফায় ভোট হচ্ছে। খাস উদয়পুর যোধপুর, বারমের, রাজসমন্দ, আজমেঢ়, ঝালোয়ার, কোটা, বনশওয়াড়ার মতো ১৩টি আসনে ২৯ এপ্রিল ভোট হবে। বাকি ১২টিতে হবে ৬ মে।
মাত্র চারমাস আগে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। তবে আবারও গেরুয়া শিবিরের মুখোমুখি তারা। মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার দু’দিনের মধ্যে রাহুল গান্ধী চাপ দিয়ে অশোক গেহলট-কে দিয়ে কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা করিয়েছেন। আর এবার তাদের অস্ত্র- বিজেপির বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। কংগ্রেসের উদয়পুরের প্রার্থী রঘুবীর সিং মিনা প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘বসুন্ধরা আমাদের লক্ষ্মী, উনি যতদিন বিজেপির হয়ে ভোট করবেন, ততদিন আমরা আরও বেশি আসনে জিতব।’
একথা ঘুরিয়ে স্বীকার করছেন উদয়পুর বিজেপির যুবমোর্চা ও এবিভিপির নেতারা। বিধানসভা ভোটে দল হারার জন্য ক্ষুব্ধ-হতাশ বিজেপি কর্মীরা বলছেন, ‘শুধুমাত্র বসুন্ধরার চরম দুর্ব্যবহার পার্টিকে হারিয়ে দিল। মন্ত্রী-বিধায়ক-নেতা সবার সঙ্গেই উনি চাকর-বাকরের মতো ব্যবহার করেন।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ পদাধিকারী বলেন, ‘পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গেও তিনি রাজকীয় স্টাইলে চরম দুর্ব্যবহার করতেন। সন্ধের পর বড় কোনও ঘটনা ঘটলে তিনি ফোন তুলতেন না।’
অন্যদিকে, বসুন্ধরা দায়িত্বে থাকলে রাজ্যে আগামী বিধানসভা ভোটের মধ্যে দল শূন্যে পৌঁছে যাবে বলেও বিজেপির ক্ষুব্ধ নেতাদের দাবি। বিজেপি যে কতটা চাপে আছে তার প্রমাণ, উদয়পুর ডিভিশন। বিধানসভা ভোটে এখানকার ২৮টি আসনের মধ্যে ২৪টি বিজেপিই পেয়েছে। সৌজন্যে আরএসএস। কিন্তু এবার হাওয়া একটু আলাদা। তবুও ড্যামেজ কন্ট্রোলে এসে সভা থেকে মোদী বালাকোট, পাকিস্তান ও সেনা জওয়ানদের বিষয়কে হাতিয়ার করেছেন। নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও।
মোদীর সেই স্বদেশপ্রেমের প্যাকেজে উজ্জীবিত হয়েই রাজ্য বিজেপির নেতা-কর্মীরা মুখে বলছেন বটে, দল ১৫-১৬টি আসন পাবে। তবে আদতে সেই পথ যে একেবারেই মসৃণ নয়, তা ভাল মতোই জানে মোদী-শাহরা। উল্টোদিকে, আবার আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলে দিয়েছেন, ২৫টির মধ্যে কংগ্রেস ২০টি আসনে নিশ্চিত। সবমিলিয়ে বলা যায়, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি হলেও মরুরাজ্যে ভোটের উত্তাপের পারদ ১০০ ছুঁই ছুঁই।