মানুষের মমতা
কর্মসূত্রে বাংলা সহ কিছু রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরার সুবাদে দেখতে পাচ্ছি এবারের ভোটে ধর্মের দাপট অন্যান্যবারের তুলনায় অনেক বেশি। আগে দুএকটা দল ভোটের সঙ্গে সরাসরি ধর্মকে জুড়ে প্রচার চালালেও দেশের বেশিরভাগ প্রধান রাজনৈতিক দল সে রাস্তায় হাঁটতো না। এবার সবাই যেন ধর্মের ব্যাপারে খুল্লম খুল্লা। ভোটের অনেক আগে থেকেই আমরা দেখছি একদল কোথাও একটা হনুমান মূর্তি বসালে অন্য দল তাকে টেক্কা দিতে আরও বড় একটা হনুমান মূর্তি বসাচ্ছে। একদল স্কুলের যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতার মত গদা হাতে হনুমান সেজে মিছিল করলেই আরেক দল নিজেদের আরও বড় হিন্দু প্রমাণ করার জন্য খোল করতাল নিয়ে কীর্তন পার্টি চালু করে দিয়েছে। এমনিতে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে একটা ইমেজ ছিল কিন্তু এবারের ভোটে রাহুল গান্ধী স্বহস্তে সে ইমেজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে হিন্দু ধর্মের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে ওয়েনাদে গিয়ে যজ্ঞ শুরু করে তিনি গোটা ব্যাপারটা ঘেঁটে দিয়েছেন। বিজেপির হিন্দুত্বের জিগিরের পাল্টা জবাবে কংগ্রেস নিয়েছে সফট হিন্দুত্বের লাইন।
বিজেপি ঠিক এটাই চাইছিল। তারা চাইছিল সব দলগুলিকে �কে বেশি হিন্দু�খেলায় টেনে আনতে। রাহুল এই ফাঁদে পা দিয়েছেন। হিন্দুত্বের সমর্থক ও বিরোধী কারোরই মন জয় করতে পারেননি তিনি। বিজেপির হিন্দুবাদ আগ্রাসী ও অন্য ধর্মের ওপর হিন্দুত্বের নামে বর্বরতা চাপিয়ে দেওয়ার এক মতবাদ। একাজ করতে গেলে তাদের একটা শত্রু চাই। ভারতবর্ষের তাদের এই শত্রু হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। হিন্দু ধর্ম সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে। বিবেকানন্দের হিন্দুবাদে কোন শত্রু ছিলনা। ছিল, আমার রক্ত, আমার ভাই বলে সব ভারতবাসীকে টেনে নেওয়ার আহ্বান। আর মোদি-অমিতদের হিন্দুবাদ কী বলে আর কী শেখায় তা আমাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবেনা। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই দেশের মানুষ তা জানেন।
আমাদের দেশের পুরনো আমলের রাজনীতিবিদদের অনেকেই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির যোগ রয়েছে বলে বিশ্বাস করলেও ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাননি, বরং দেশের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তারা। হিন্দু মহাসভার আমলে তো বটেই এমনকি বিজেপির সূচনাপর্বেও এখনকার মত সবকিছু দখল করবো, সবকিছু করায়ত্ত করবো এমন মনোভাব ছিলনা। হিন্দুত্বের এই আগ্রাসী ব্র্যান্ডটি মোদি-অমিতরাই জন্ম দিয়েছেন।
এই নিয়ে দেশে তিনবার রামনবমী ভোটের মধ্যে পড়লো। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে কোনবারই তা এবারের মত গুরুত্ব পায়নি। মূলত উত্তরভারতের এই জনপ্রিয় উৎসবটিকে নিয়ে দেশজোড়া এত সাজো সাজো রব এবারেই প্রথম দেখলাম। বিজেপি ও তার শাখা সংগঠনগুলি খুব পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করার জন্যই রামনবমী পালন করেছেন। শাস্ত্র ও পুরাণের রেফারেন্স দিয়ে বহু জায়গাতেই সেই মিছিল ছিল সশস্ত্র। ভাবতে অবাক লাগে বাংলার মত রাজ্যেও এই পরিকল্পিত রাম ভজনার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অন্যকিছু দলও সশস্ত্র মিছিল বার করে ফেললো। আমাদের পাড়ার মোড়েই দেখলাম প্যান্ডেল বেঁধে রামনবমী হচ্ছে। বোঝো ব্যাপারখানা! আমি ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোঁজখবর নিতেই শুনলাম, না না এতে দলের কোন ব্যাপার নেই। কর্মীরা নিজেদের মত করে রামনবমী পালন করছেন। ধর্মাচরণের স্বাধীনতা তো সবারই আছে।
কিন্তু রাম রাজ্য মানে তো সবাই মিলেমিশে থাকা, বহুত্বকে স্বীকার করা। রাম তো গুহক রাজারও আতিথেয়তা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এই সশস্ত্র ও উস্কানিমূলক ধর্মাচরণ কতটা যুক্তিসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কোন ধর্মীয় মিছিল সশস্ত্র হলে, সেখান থেকে উস্কানি ও বিভেদমূলক প্রচার হল কিনা তা দেখার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন রয়েছে। আমার প্রশ্ন হল যে মিছিল থেকে হাঙ্গামা হওয়ার আশঙ্কা থাকে সেই মিছিলের অনুমতি দেওয়া হবে কেন? প্রশ্ন হল ধর্মের নামে রাজনীতি� যখন উত্তেজনা ও মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়াচ্ছে তখন রাজনীতি তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে কেন? এর উত্তর হল সহজসিদ্ধি। সত্যিকারের একটা জনমুখী নীতি ও উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে মানুষের মন জয় করার কাজে পরিশ্রম আছে, এতে ভাবনাও লাগে। বিজেপি সে কাজে ব্যর্থ হয়েছে। মোদি-অমিতরা এতটা এতটা পরিশ্রম করতে নারাজ। তাদের চাই শর্ট কাট মেথড। ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে এই কাজটা অতি সহজে করে ফেলা যায়।
ছোটবেলায় ছোটদের রামায়ণ পড়ার সময় হনুমান ছিল একইসঙ্গে শক্তিমান ও মজাদার একটি প্রাণী। কখনও সে ল্যাজের আগুনে লঙ্কা ছারখার করছে, কখনও মজাদার ভঙ্গীতে কলা খাচ্ছে। কোনসময়ই তাকে একটি হিংস্র প্রাণী বলে মনে হয়নি। আজকের রাজনীতি তাকে হিংস্র বানিয়ে ছেড়েছে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল ভাল জিনিসের থেকে লোকে খারাপ জিনিস বেশি শেখে। যে সিপিএম বাংলায় পুজো বা উৎসবের সময় মার্কসবাদী বইয়ের স্টলের বাইরে কিছু করতো না তারাই এখন আরএসএস সৃষ্ট রামের থেকে প্রকৃত রামকে আলাদা করার কর্মসূচি নিচ্ছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই ধর্ম ও রাজনীতির সীমারেখাটা খুব সচেতনভাবে মেনে চলেন। দুটোকে কোন অবস্থাতেই তিনি গুলিয়ে ফেলেন না। তিনি বলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্তু উৎসব সবার। কোন ধর্ম নয়, মানুষের মধ্যে মানুষকেই খোঁজেন তিনি। আজকের রাজনীতিতে সেটাই যেন কমে আসছে।
খবরের কাগজের ছবিতে দেখছিলাম শ্রীলঙ্কার সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চে ধর্মীয় মৌলবাদীরা যে নৃশংস মারণযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে যীশুর মূর্তির গায়েও রক্তের ছিটে লেগেছে। ধর্মের সঙ্গে মেশা রাজনীতি আর রাজনীতির সঙ্গে মেশা ধর্ম আজ মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরদোয়ারা সবকিছুর গায়েই লাগিয়ে দিয়েছে রক্তের দাগ। এ দাগ মোছার দায় কিন্তু মানুষকেই নিতে হবে। বিভেদকামী বিজেপি ধর্মের আশ্রয় নিয়ে সমাজে সন্ত্রাস ও হিংসা ছড়াচ্ছে। ধর্ম মানে নৃশংসতা নয়। এবারের ভোট আপনার আমার সবার কাছে বিজেপির ধর্মীয় মৌলবাদকে রোখার সুযোগ করে দিয়েছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত