পয়লা বৈশাখ মানেই পুরোনো বছরকে সাদা কাপড় দিয়ে সযন্তে ঢেকে রেখে একটা নতুন বছরের শুরু। পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির কাছে রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গান দিয়ে শুরু সকাল। সকাল বেলার আড্ডা, পঞ্চব্যাঞ্জন, আর সন্ধে নামলেই দোকানে দোকানে হালখাতার ভিড়। সাত রকমের মিষ্টি ভরা প্যাকেট আর নতুন বছরের ক্যালেন্ডার। কোথাও কালী, কোথাও কৃষ্ণ, কোথাও শিব তো কোথাও আধুনিক কোনও বিদেশি ছবি বা গ্রামের দৃশ্যপট। নীচে লেখা দোকানের নাম। বাংলা ক্যালেন্ডার মানে তো শুধু প্রতিদিন শেষে একটা করে পাতা ছিড়ে ফেলা না। বাংলা ক্যালেন্ডার মানে, দিদিমার একাদশী, অমাবস্যা, আর অনেক অনেক স্মৃতি আঁকড়ে থাকা। আগে হালখাতার পর বাড়ি ফিরে দেখা হত কোন দোকানের ক্যালেন্ডারে কী ছবি, কোনটা ভাল, কোনটা বেশি সুন্দর। এসব এখন কেবল ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত হয়ে রয়ে গেছে। কারণ মানুষ যত এগোচ্ছে, ততই ব্যস্ততার বহর বাড়ছে।
পয়লা বৈশাখের এ ছবি বদলেছে অনেকখানি। আগে ওই ক্যালেন্ডারের জন্য বসে থাকত গোটা পরিবার। এখন আর কদর নেই তার। দেওয়ালে টাঙানোর ক্যালেন্ডার কোনও দোকান থেকে দিলেও তাঁর ঠাঁই হয় আস্তাকুঁড়ে। ‘‘দামী রঙ করা দেওয়ালের সৌন্দর্যের সঙ্গে ক্যালেন্ডারটা ঠিক যায় না’’, সাফ বলেন কলেজ পড়ুয়া এক তরুণী। আর দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার তো প্রায় বিলুপ্ত তবে কিছু টেবিল ক্যালেন্ডার রয়ে গেছে। কিন্তু তাকেও বা ক’জন পাত্তা দেয়। সময়, দিনক্ষণ, কি বার এসব তো এখন মোবাইলের স্ক্রিনেই থাকে। তাই আলাদা করে ক্যালেন্ডারের কি দরকার!
কিন্তু এই কেতায় কাজ হারাতে বসেছেন বেশ কয়েক হাজার মানুষ। একটা সময় ছিল যখন ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ছাপাখানায় দম ফেলার ফুরসত থাকত না। দিন-রাত এক করে কাজ করেও সময়ে ক্যালেন্ডার পৌঁছে দেওয়া যেত না দোকানগুলির হাতে। আর এই বেশি কাজের সুযোগে কিছু বেশি উপার্জনও করে নিতেন শ্রমিকরা। সে সব দিনে গিয়েছে। ঠিক যেভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে এখন আর কেউ লাল শালু মোড়া হালখাতার খাতা নেন না৷ কম্পিউটারই হিসেব রাখার সহজ উপায়। ঠিক সেভাবেই দর নেই ক্যালেন্ডারেরও। হুগলির এক ছাপাখানার শ্রমিক অজয় দাস। তিনি বলেন, ‘‘এখন যে টুকু ক্যালেন্ডার ছাপা হয় তাতে সময়ের মধ্যেই সরবরাহ করা যায় দোকানে দোকানে। কাজ হারানোর আশঙ্কায় ভুগছি।’’
বর্ষীয়ান আর এক ছাপাখানা মালিক বলেন, ‘‘নববর্ষের আগে সময়মতো খাতা, ক্যালেন্ডার সরবরাহের জন্য বেশি টাকা দিয়ে শ্রমিক রাখতাম। এখন আর তা লাগে না”৷ কালে কালে প্রযুক্তি এগোনোর ফলে ছাপাখানার কাজ, কাগজ শিল্পের এ সব শাখা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। দিনে দিনে কদর কমছে পুরোনো ঐতিহ্যের।