মানুষের মমতা

আসামের ভূমিপুত্র ভূপেন হাজারিকা গান বেঁধেছিলেন মানুষ মানুষেরই জন্যে। আবার তিনিই গেয়ে উঠেছিলেন গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা। ভ্রাতৃত্বের সেই আদর্শ ধ্বংস করে বাংলা ও আসামের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন এক্সপায়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদিবাবু। এনআরসি-র নামে আসামের ৪০ লক্ষ মানুষকে বিদেশী আখ্যা দিয়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু করে দিয়েছেন তিনি। বাংলা ও আসামকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। শুক্রবার আসামের ধুবড়ির নির্বাচনী সভায় এভাবেই আসামের মানুষের আবেগকে স্পর্শ করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরসি এবং সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এর সাঁড়াশি আক্রমণে বিধ্বস্ত মানুষকে লড়াইয়ের রাস্তা দেখালেন তিনি। বললেন, এনআরসি-র নামে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে বিজেপি। ওদের তৈরি করা বিদেশীদের তালিকায় হিন্দু, মুসলিম, গোর্খা, খৃস্টান সবারই নাম রয়েছে। ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের ভোটকে সংহত করার জন্যই বিজেপি এটা করছে বলে মানুষকে তিনি সতর্ক করে দিলেন। এবারের ভোটে আসামে এনআরসি সবচেয়ে বড় ইস্যু। জাতি-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আসামের সব মানুষদেরকে এক হয়ে এই চক্রান্ত রুখে দেওয়ার ডাক দিলেন তিনি।
তৃণমূলনেত্রী জানালেন, এই লড়াইয়ে বাংলাও আসামের সাথে আছে। আসামের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের দিদি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। এনআরসি নিয়ে ঘোষণার পরপরই তিনিই প্রথম আসামের উদ্বাস্তু বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দলের তরফে সরজমিন অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন প্রতিনিধি দল। দেশের অন্য কোন দল বিজেপির এই ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রথমে সরব হয়নি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সভায় বললেন, দেশে কে কোথায় থাকবে তা ঠিক করার অধিকার প্রধানমন্ত্রীকে কেউ দেয়নি। তিনি নিজেই সেই দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট কার্যকর হলে এই আইনের আওতায় আসা যে কোন বৈধ নাগরিক ছবছরের জন্য বিদেশী হয়ে যাবেন। তারপর বিচার হবে তিনি তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন কিনা! এই সময় তার চাকরি, পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া, চিকিৎসা, ভোটদানের কী ব্যবস্থা হবে তা কেউ জানে না। স্রেফ ভোটে জেতার জন্য মোদিবাবু এই খেলায় মেতেছেন।
ধুবড়ির সভাস্থলে আমি আজ পৌঁছে গিয়েছিলাম একটু আগে। দূরদূরান্ত থেকে নদী এবং গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে মানুষরা তাদের প্রিয় দিদির কথা শোনার জন্য তখন �আস্তে আস্তে জড়ো হচ্ছেন। টুকরো টুকরো কথাবার্তা থেকে আভাস পাচ্ছিলাম এনআরসি সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ওপর তারা খুব নির্ভর করছেন। এবারের ভোটে ইভিএম-এ মোদির চক্রান্তের জবাব দেওয়ার জন্য তারা তৈরি। মনের খুশিতে সভাস্থলের একপাশে বিহু নাচ করছিলেন কিছু তরুণী। অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে দেওয়া সমস্যা ও অনিশ্চয়তা তাদের জীবন থেকে নাচ- গান মুছে ফেলতে পারেনি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আজ জুম্মাবার তাই অনেকের আসতে দেরি হচ্ছে, আমরাও শুক্রবার সন্তোষী মার পুজো করি। প্রতিটি ধর্মের মানুষেরই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ধর্মাচরণের স্বাধীনতা আছে। মোদিবাবুরা এটাই স্বীকার করতে চান না।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানান, আসামের সংগঠন গড়ার কাজ তারা খুব একটা বেশি দিন আগে শুরু করেননি তবুও এর মধ্যেই তারা যতটা সম্ভব মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। আসামে তৃণমূলের শক্তি বাড়ছে। সমস্যা থাকতেই পারে কিন্তু তার সমাধান করার ইচ্ছেটাই বড় কথা। এই ইচ্ছে ছিল বলেই ৬০ বছর ধরে চলা বাংলার যে ছিটমহল সমস্যা কংগ্রেস, সিপিএম কেউ সমাধান করতে পারেনি তৃণমূল তা করতে পেরেছে। সারদা নিয়ে মোদিবাবু বাংলায় গলা ফাটাচ্ছেন অথচ সারদার থেকে টাকা নেওয়া আসামের বিজেপি সরকারের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে তিনি একটি কথাও বলছেন না। হিমন্ত যে সারদাকান্ডে যুক্ত তার প্রমাণ হিসেবে সভায় দিদি একটা ডকুমেন্টও পেশ করেন।
আজ থেকে বহুদিন আগে সমাজসংস্কারক শঙ্করদেব প্রেম ধর্মের জোয়ার এনেছিলেন নদী পাহাড় দিয়ে সাজানো উত্তরপূর্বের এই জনপদে। বন্যা, দাঙ্গা, উগ্রপন্থী সন্ত্রাসে বারবার বিধ্বস্ত মানুষ জীবনকে ভালোবেসে সামনে এগোতে চেয়েছেন। মোদিবাবুদের মত বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদরাই তাদের পিছনে টেনে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, আসামে তৃণমূলের শিকড় কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে এবারের ভোটেই বিজেপি তা টের পাবে। বিভেদের রাজনীতিকে তুচ্ছ করে, নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে আসামের মানুষ আবার গেয়ে উঠবেন মানুষ মানুষের জন্যে। বিজেপির সহানুভূতিহীন রাজনীতি অতীত হয়ে যাবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত