কীর্তিমান, সফল, বিখ্যাত বা কুখ্যাত মানুষদের নিয়ে চর্চা সেই পুরাণের আমল থেকে হয়ে আসছে। এমনকি স্বর্গের দেবদেবীরাও নাকি মর্তের বিখ্যাত ও কুখ্যাত মানুষজনের খোঁজখবর রাখতেন এবং তাদের পুরষ্কার-তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। এটা এখনও হয়। আমরা দেখি পৃথিবীর নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে একালের নানা বিখ্যাত মানুষকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এসব দেখেশুনে ভাবছিলাম, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনও তো একটা গবেষণার বিষয়। একটা অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে আজকে তিনি একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দক্ষভাবে সামলাচ্ছেন; কয়েকবার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন; নিজের চেষ্টায় একটি দল গড়ে তুলে রাজ্য থেকে অত্যাচারী ও জনবিরোধী সিপিএমকে উৎখাত করেছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের � এমন জীবন নিয়ে গবেষণা হবে না তো কী নিয়ে হবে?
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলা থেকে যতজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গোটা দেশে পরিচিতি লাভ করেছেন তাদের মধ্যে বিধান রায়, জ্যোতি বসু এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর যার নাম আসবে তিনি হলেন আমাদের দিদি। এদের মধ্যে বিধান রায় ও জ্যোতিবাবু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কাজ করেননি। দিদি ও প্রণববাবু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক ও দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু প্রণববাবুও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কখনোই দিদির মত এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেননি। তাকে ঘিরে কখনোই দেশের বিরোধী রাজনীতি এতটা আবর্তিত হয়নি। বাংলার শাসনক্ষমতা ও সাংসদে আসনসংখ্যার জোরে ডিজাইনার পোশাক পরে দিল্লিতে একসময় কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করলেও জ্যোতিবাবুকে দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা দাবিয়ে রেখেছিলেন।
দেশের বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি বাংলার তৃণমূল নেত্রী সিপিএমের গুণ্ডা ও তাঁবেদার পুলিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন রাস্তায় নেমে। বারবার প্রহৃত হয়েছেন এমনকি প্রাণসংশয়ও হয়েছে তার। কদর্য ভাষায় তাকে আক্রমণ করেছেন সংস্কৃতির বড়াই করা বামপন্থী নেতারা। তবুও তাকে দমানো যায়নি। আমি জোর গলায় বলতে পারি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ছাড়া দেশের কোন নেতা নেত্রী এমনভাবে আক্রান্ত হননি। অনশন, আক্রমণ, চরিত্রহনন সবকিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। নিজের জীবন বাজি রেখে এমন রাজনীতিও কেউ করেননি। আমার মনে হয়, দিদি নিজেই তো একটা গবেষণার বিষয়। আধুনিক ভারতের রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে যে কোন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আসবেই।
আমাদের অ্যাকাডেমিক মহলে তিনি কেন অচ্ছুৎ হয়ে রইলেন, কেন জায়গা পেলেন না কোন গবেষণায় তা সত্যিই একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। এসব ভাবতে ভাবতেই খোঁজ পেলাম রেজাউল করিমের। তিনি একমাত্র লোক যিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার অবাক লাগে রাজনীতি সচেতন এই বাংলায় এত সমসাময়িক একটা বিষয়কে মাত্র একজন গবেষক স্পর্শ করলেন! এমনকি দিদির চারপাশে যারা ভিড় করে থাকেন সেই বুদ্ধিজীবীকুলও এমন কোন গবেষণার কথা ভাবলেন না! বিষয়টা আমি গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছেন, সত্যিই তাকে নিয়ে একটা সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক কাজ হওয়া উচিৎ। আমার অবাক লাগে এমন উচিৎ কাজটা হল না কেন? হয়তো টালির বাড়ি থেকে উঠে এসেছেন বলেই তিনি উচ্চকোটির অ্যাকাডেমিক চর্চায় কল্কে পাননি।
ভাবমূর্তি নির্মাণে তৎপর মোদিকে নিয়ে গবেষণা শেষ করে ফেলেছেন মেহুল চোকসি। না, ইনি মোদি যাকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে সেই কুখ্যাত মেহুল চোকসি নন। ইনি সুরাটের এক আইনজীবী। তার গবেষণার বিষয় নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনিক নেতৃত্ব। গবেষণা শেষ হওয়ার পর তিনি ডক্টরেটও হয়েছেন। দুর্জনেরা বলছেন, ভোটের মুখে এই গবেষণা মোদির রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
শুধু লড়াই নয়, গত কয়েক বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্য ও উন্নয়নের সুবাদে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসক হিসেবে দক্ষতাও প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণাই করতে পারে তার কাজের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। অবিলম্বে আমাদের দিদিকে নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার কাজ শুরু হওয়া উচিৎ। স্বাধীনভাবে কাজ করুন সেই গবেষকরা, তার ফল নিয়ে কোন ছুঁৎমার্গ থাকাটা উচিৎ হবেনা। যা সত্যি তা দিনের আলোর মত প্রকাশিত হোক। কাউকে উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। সবসময় দিদির আশেপাশে ভিড় করে থাকা বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা যদি এই ব্যাপারটার দিকে একটু মনোযোগ দেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আমি নিজে দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখছি, কিন্তু তাকে নিয়ে একটা বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার মেধা ও যোগ্যতা আমার আছে বলে আমি মনে করিনা। এটা শিক্ষাবিদ ও বিদ্বজনেদের কাজ। তারাই তো গবেষণা করতে আসা মানুষদের গবেষণার বিষয় কী হবে তা নিয়ে পরামর্শ দেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা তাদের দিক থেকেই আসা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। তারাই নবীন গবেষকদের এব্যাপারে পথ দেখাতে পারেন। কথা, কাজ, লড়াই ও ত্যাগ মিলিয়ে এমন ঘটনাবহুল ও লড়াকু জীবন এখন দেশের মূলধারার কোন রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীর নেই। আমাদের গবেষণার একটা চিরকেলে ঝোঁক রয়েছে, তা হল জীবন্ত বিষয়কে বাদ দিয়ে মৃত বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গবেষণার মধ্যে দিয়ে গবেষণায় ফিরে আসুক বাংলার এক জীবন্ত ইতিহাসের চর্চা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত