কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায়, পাড়ার ভিতর বা বড়রাস্তার মোড়, গলিপথ থেকে রাজপথ— সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে ‘দেশপ্রেমী’দের। সময়ের কোনও ঠিক নেই। দুপুর হোক বিকেল হোক, কিংবা সন্ধে বা মাঝরাত, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন ‘বীরপুরুষেরা’। মুখে স্লোগান- ‘ভারতমাতা কি জয়’। শুধু তাই নয়, সেইসঙ্গে অশ্লীল ভাষায় দুষছেন প্রতিবেশী দেশকে। গালিগালাজের পাশাপাশি মা-বাপ উদ্ধার করতেও ছাড়ছেন না কেউ কেউ।
রাতে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে এমনই এক দেশপ্রেমীর দলের হাতে পড়েন মাঝবয়সি এক ইঞ্জিনিয়ার। আচমকাই তাঁর পথ আটকে দাঁড়ায় চারটি বাইক। গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে মারধর করা হয় ইঞ্জিনিয়ারকে। সঙ্গে শাসানি, ‘খুব মুসলিম দরদি হয়েছিস? খুব কাশ্মীর প্রেম? ভারতমাতা কি জয় বল।’ মেরে তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে জানানোর পরই এই মারধর-হেনস্থা বলে দাবি দীপায়ন ধর নামে ওই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের। বুধবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ হামলার পরে দীপায়ন মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। হামলাকারীদের কাউকে চিনতে পারেননি তিনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘অভিযোগ খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
দীপায়নের বাড়ি কলকাতায়। কর্মসূত্রে এখন মেদিনীপুর শহরে থাকেন তিনি। আমতলার অদূরে একটি প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার দীপায়ন বুধবার রাতে মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন আমতলার কাছেই তিনি নিগৃহীত হয়েছেন বলে অভিযোগ। বৃহস্পতিবার দীপায়ন জানান, ‘পুরো ব্যাপারটা পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে ঘটেছে। ওরা বাইকে এসেছিল। মারধর-হুমকির পরে বাইক নিয়েই খড়গপুরের দিকে চলে যায়।’
পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলায় জওয়ানদের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে নিজের মতামত পোস্ট করেছিলেন এই ইঞ্জিনিয়ার। দীপায়নের মতে, পাকিস্তান মানেই সব মানুষ খারাপ, তিনি মনে করেন না। হিংস্রতার বিরুদ্ধে হিংস্রতা, এই সমাধানে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে। দীপায়ন লেখেন, ‘যুদ্ধ হচ্ছে মৃত্যু মৃত্যু খেলা, যুদ্ধ হচ্ছে তোমার কাছে আমার অবহেলা।’ সেদিনের হামলার পরও দীপায়ন বলেন, ‘দেশকে সত্যি ভালবাসেন এমন কেউ এ ভাবে হামলা করতে পারেন না। আমার মতের পক্ষে অনেকের সমর্থন রয়েছে। আমিও তাই মানুষেই আস্থা রাখছি।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধ বিরোধী মন্তব্যের জেরে মারধর চলছে রাজ্যের নানা প্রান্তে। মেদিনীপুরে এই প্রথম। এই ঘটনার পর তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি অজিত মাইতির অভিযোগ, ‘দেশপ্রেমের নামে বিজেপির লোকেরাই হুমকি দিচ্ছে, মারধর করছে।’ তবে, পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার আগে থেকেই গুজবের জেরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনি ও হিংসা ছড়ানো হচ্ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে জেলা ও কলকাতা পুলিশ এবার কোমর বেঁধে নেমেছে এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করতে। মাইকে প্রচার করা হচ্ছে এবং লিফলেটও বিলি করা হচ্ছে। এর ফলে অনেকটা সুফল মিলছে।