গতকালই ‘দ্য হিন্দু’ এক নতুন তথ্য ফাঁস করে জানিয়েছিল, রাফাল কেনা নিয়ে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, তা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতি বিরোধী শর্ত। আর আজ মোদী সরকারের মাথাব্যথা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক জানায়, রাফাল চুক্তির সরকারি ঘোষণার সপ্তাহ দু’য়েক আগেই প্যারিসে গিয়ে ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জঁ-ইয়েভেস লে দ্রিয়াঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন শিল্পপতি অনিল আম্বানি।
ওই সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, ওই সময় ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অফিসে তাঁর দফতরের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও হয় অনিলের। সেটা ছিল ২০১৫ সালের মার্চের চতুর্থ সপ্তাহ। তার দু’-এক দিনের মধ্যেই ২৮ মার্চ অনিলের নতুন সংস্থা ‘রিলায়্যান্স ডিফেন্স’-এর গোড়াপত্তন হয়। আবার ওই বৈঠকের পর দু’সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই এপ্রিলের মাঝামাঝি প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তদানীন্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওল্যাদ যৌথ ভাবে ঘোষণা করেন, ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আজ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী দিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদী যে অনিল আম্বানিদের দালাল হিসেবে কাজ করেছেন, সেটাই প্রমাণিত হল।’ ওই তদন্তমূলক প্রতিবেদনটি আরও জানিয়েছে, আর কিছু দিন পরেই রাফাল চুক্তি হবে আর তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হবে, সেটা জেনেই মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে প্যারিসে গিয়েছিলেন অনিল আম্বানি। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী মোদী প্যারিসে গিয়েছিলেন ২০১৫-র ৯ এপ্রিল। তিন দিনের সফরে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ফ্রান্সে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে কারা কারা ছিলেন আম্বানির সঙ্গে বৈঠকে? প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, সেই বৈঠকে ছিলেন ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা জঁ-ক্লদ মালে, শিল্প উপদেষ্টা ক্রিস্তোফে সলোমন ও শিল্প বিষয়ক প্রযুক্তি উপদেষ্টা জিওফ্রে বোকত। জানা গেছে, অনিল অম্বানীর সঙ্গে সেই বৈঠকের পর ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর শিল্প উপদেষ্টা ক্রিস্তোফে সলোমন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা সংস্থা ‘এয়ারবাস হেলিকপ্টার্স’-এর শীর্ষ কর্তাদের জানিয়েছিলেন সব কিছু। চুক্তিটা যে হচ্ছেই, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন। সলোমন বলেছিলেন, ‘খুব অল্প সময়ের নোটিসে অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে বৈঠক হয়েছে। যা যা ঠিক করা ছিল, সেই সব কিছু নিয়েই সবিস্তারে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে।’
অনিল আম্বানি কী বলেছিলেন বৈঠকে? মার্চের শেষাশেষির ওই বৈঠকে হাজির থাকা ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ও প্রতিরক্ষার জন্য ওই সময়েই অনিল ‘এয়ারবাস হেলিকপ্টার্স’-এর কাছ থেকে হেলিকপ্টার কেনার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এ-ও বলেছিলেন, মোদী প্যারিসে এলে বিষয়টিকে পাকাপোক্ত করার জন্য যেন একটি সমঝোতাপত্র বা মউ-এর খসড়া বানিয়ে ফেলা হয়। তবে ওই বৈঠকের পরেও প্যারিসে থেকে গিয়েছিলেন অনিল। উদ্দেশ্য, মোদীর সঙ্গে যাতে সেখানেই সব কথা বলে নেওয়া যায়। তারপর ৯ এপ্রিল মোদী প্যারিসে পৌঁছলে অনিল পরিকল্পনা মতো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা দলের সদস্য হয়ে যান। মোদীর সঙ্গেই অনিলকে সর্বত্রই ঘুরতে দেখা যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে এ-ও জানা গেছে, প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য ইমেল পাঠানো হয়েছিল লে দ্রিয়াঁর মুখপাত্র ও অনিল আম্বানির রিলায়্যান্স গ্রুপের কাছে। কিন্তু কেউই কোনও জবাব দেয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের আগেই অনিল আম্বানির ফ্রান্সে চলে যাওয়ার খবরটি রটে গিয়ে যাতে কোনও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি না হয়, সে জন্য মোদীর প্যারিসে পৌঁছনোর আগের দিনই (৮ এপ্রিল, ২০১৫) তদানীন্তন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রাফাল নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তাতে ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, ফরাসি অস্ত্রনির্মাতা সংস্থার সঙ্গে রয়েছে হ্যাল-ও। আর প্রধানমন্ত্রীর সফরের সঙ্গে এই চুক্তির কোনও সম্পর্ক নেই। ওই সব কথাবার্তা (রাফাল সংক্রান্ত) আলাদা ভাবে চলছে।’
দ্য হিন্দুর পাশাপাশি এই প্রতিবেদনটিও যে ভোটের মুখে বিরোধী অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠতে চলেছে, তাঁর ইঙ্গিত মিলেছে রাহুলের আক্রমণেই। অন্যদিকে, এই প্রতবেদনটি প্রকাশ আরও খানিকটা ব্যাকফুটে কেন্দ্রের মোদী সরকার।