বাংলার শক্ত মাটিতে যে দাঁত ফোটানো শক্ত, তা এতদিনে স্পষ্ট বুঝে গেছেন তিনি। ইদানীং তাই ঘনঘন রাজ্যেও আসছেন। সেই চেনা স্বর ও সুরে নাটকীয় ভাবে ‘দিদি’ ‘দিদি’ বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন তিনি। দুর্গাপুরে সভাতেও যথেষ্টই আক্রমণাত্মক দেখেয়েছে তাঁকে। কিন্তু দিদিকে চাপে ফেলার আগেই এবার রাফাল বিতর্কে নিজেই প্রবল চাপে পড়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
রাফাল চুক্তিতে যে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ হয়েছে তা প্রমাণ করতে সর্বভারতীয় স্তরে মরিয়া বিরোধীরা। সজাগ সংবাদমাধ্যমের একাংশও। শুক্রবার সকালে সেই তদন্তমূলক সাংবাদিকতার মাধ্যমেই ‘দ্য হিন্দু’ কাগজের একদা সম্পাদক এন রাম একটি প্রতিবেদনে উস্কে দিয়েছেন নতুন বিতর্ক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি নোট প্রকাশ করে দিয়ে রাম দেখিয়েছেন, রাফাল নিয়ে দাসো এভিয়েশনের সঙ্গে দরকষাকষিতে বিলক্ষণ জড়িত ছিল প্রধানমন্ত্রীর সচিবলায়। যা নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তাদের তীব্র আপত্তি ছিল।
২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অফিসাররা তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিক্করকে এই নোটটি পাঠিয়েছিলেন। তাতে কঠোর ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘সুতরাং এটা স্পষ্ট, যে সমান্তরাল দরকষাকষি (রাফাল নিয়ে) প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় চালাচ্ছে, তাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং মন্ত্রকের দরকষাকষি সংক্রান্ত টিমের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে আমরা অনুরোধ করতে পারি যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের টিম ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কোনও অফিসার যেন ফরাসি সরকারের সঙ্গে কোনও সমান্তরাল আলোচনা না চালায়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের উপর যদি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের আস্থা না থাকে, তা হলে নতুন করে দরকষাকষি শুরু করতেই পারে।’
সন্দেহ নেই, লোকসভা ভোটের আগে এই নোট ফাঁস হয়ে যাওয়া মানে জাতীয় রাজনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়া। বৃহস্পতিবারও লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী রাফাল প্রসঙ্গে কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়ে বলেছিলেন, এ ব্যাপারে মিথ্যা প্রচার হচ্ছে। বরং এর আগে সততার সঙ্গে কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করা হয়নি। কখনও চাচা কখনও বা মামা এসে পড়েছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এই ফাঁস হওয়া নোট মোদীর দাবিকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
কারণ, এই নোট অনেক প্রশ্ন তুলছে। প্রথমত কীসের স্বার্থে রাফালের দরকষাকষিতে নাক গলিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়? কাউকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল কি? তা ছাড়া রাফায়েল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলার সময় সরকারের তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছিল যে , প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় এ ব্যাপারে কোনওরকম দরকষাকষির মধ্যে ছিল না। ফরাসি সরকারের সঙ্গে যা দরকষাকষি করার, তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকই করেছে। ফলে আদালতে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। যা সুপ্রিম কোর্টকে অবমাননা করার সামিল।
স্বাভাবিক ভাবেই এদিন সাত সকালে ওই নোট হাতে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, ‘তা হলে প্রমাণ হয়ে গেল যে চৌকিদারই চোর। মোদীজি তো আমার আপনার সুবিধার জন্য রাফায়েল নিয়ে দরকষাকষিতে নাক গলাননি। তা তিনি করেছিলেন, অনিল আম্বানিকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ফায়দা পাইয়ে দিতে।’ অন্যদিকে, এই নোট ফাঁসের ঘটনায় ফের নাম উঠে এসেছে প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিক্করের। মাঝে একটি অডিও টেপ ফাঁস হয়েছিল তাঁকে নিয়ে। তাতে শোনা যাচ্ছিল, গোয়ার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পারিক্কর মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, রাফাল চুক্তি নিয়ে তাঁর বেডরুমে কাগজ রেখে দিয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি এই নোটটির কথাই বলতে চেয়েছিলেন? রাজনৈতিক ভাবে পারিক্কর সৎ ও নিষ্ঠাবান বলেই পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতির কোনও অভিযোগ নেই। অনেকের মতে, হয়তো বা নিজের সততার প্রমাণ রাখতেই কিছু নথির প্রতিলিপি নিজের কাছে রেখেছিলেন পারিক্কর। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় দরকষাকষি করার ফলে কোনও বিতর্ক তৈরি হলে তাঁর ঘাড়ে দায় পড়তে পারে। সম্প্রতি অসুস্থ পারিক্করের সঙ্গে গোয়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন রাহুলও। সব মিলিয়ে নোট ফাঁস নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা থাকলেও এই ঘটনায় আরও কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেল মোদী সরকার।