আমরা প্রায় সবসময় কী হয়নি, কী পাইনি এসব নিয়ে আক্ষেপ করি। লক্ষ্য করে দেখেছি স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস কিংবা বলিদান দিবসের মত বিশেষ বিশেষ দিনে এসব আক্ষেপ চরমে ওঠে। নিজেকে বাদ দিয়ে জগৎসংসারে সবকিছুর ওপর দোষারোপ করি আমরা। এবারও প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন ঠিক একই অনুভূতি হচ্ছিল আমার। তবে এবার আমি আর অভিযুক্তদের তালিকা থেকে নিজেকে বাদ দিচ্ছিলাম না। নিজের নানা ব্যর্থতার জন্য দোষ দিচ্ছিলাম নিজেকেও। সত্যিই কি আমরা যা ভাবি, যা বলতে চাই, যা করতে পারি তা করি? কিংবা করতে চেষ্টা করি? বাক স্বাধীনতা বা নিজের ইচ্ছে মত কিছু করার স্বাধীনতা কী আমাদের আছে? �
একটু আগেই দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ফিরেছি, খুব ক্লান্ত শরীরে বসে বসে এসব সাতপাঁচ ভাবছিলাম। হঠাৎ মামমাম মানে আমার খুড়তুতো বোন বিপাশা মজুমদারের ফোন। ও কবিতা নিয়ে ভাবে, লিখতে চেষ্টা করে এবং আবৃত্তি শেখে। আমার বন্ধু বিখ্যাত আবৃত্তিকার তাপস রায়, প্রণতি ঠাকুর, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় �ওকে এব্যাপারে সহায়তা করে। আমিও আমার মত করে সাহায্য করি। যাইহোক ও আমাকে বললো, দাদা এই প্রথম আমি কোন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি। সেখানে পাঠ করবো বলে একটা কবিতাও নির্বাচন করেছি, কেমন হয়েছে একটু শুনবে? এই বলে ও আমাকে বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতাটা শোনালো। ১৯৭১সালে লেখা এই বিখ্যাত কবিতাটি এখন তো ইতিহাস হয়ে গেছে। আমারও কবিতাটা বেশ ভালো লাগে। মনে পড়লো সুনীলদার জন্মদিনে শামসুরদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অসম্ভব সুপুরুষ শামসুর কবিতা পড়েছিলেন সেদিন।
স্বাধীনতাকে যিনি কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার, গৃহিণীর খোলা কালো চুল, শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক, বোনের হাতের পাতার মেহেদির রঙ এবং যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, তার কবিতা নিয়ে কিছু বলার দুঃসাহস আমার নেই। সুখী জীবন, মানুষের নিজের ইচ্ছে মত অবাধভাবে বাঁচার জায়গাটাই তো এখন গোটা পৃথিবী জুড়েই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ১৯৭১সালে লেখা এই কবিতাটা যেন বলতে চেয়েছে মানুষের অবাধ ইচ্ছেপূরণের গল্প। প্রজাতন্ত্রের মূল ভাবনাটাও তো তাই। কবিতার কাছে নতজানু হলাম আমি। অনেকেই পড়েছেন জানি, তাও কবিতাটা আপনাদের কাছে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না।
স্বাধীনতা তুমি
শামসুর রাহমান
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক
রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।