এবারের লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে হিন্দুত্বের আবেগ উস্কে দিতে বিজেপির মূল অস্ত্র ছিল রামমন্দির। ভোটের ফল বলছে রামমন্দিরের রাজ্যেই ‘মোদী ঝড়’ রুখে দিয়েছেন সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র প্রধান অখিলেশ যাদব এবং তাঁর সহযোগী কংগ্রেস।
উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৭টিতে জিতে একক বৃহত্তম দল হয়েছে এসপি। সহযোগী কংগ্রেস জিতেছে ছ’টিতে। অন্য দিকে, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল জিতেছে ৩৩টি লোকসভা আসনে। সহযোগী আরএলডি (রাষ্ট্রীয় লোকদল) দু’টি, আপনা দল(এস) একটিতে। নাগিনা আসনে একক শক্তিতে লড়ে জিতেছেন দলিত সংঘঠন ভীম আর্মির প্রধান তথা আজাদ সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ ওরফে রাবণ। বারাণসীতে ২০১৪ সালে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জেতা মোদী এবার ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন!
প্রসঙ্গত, ২০১৪-য় দেশজোড়া পদ্মঝড়ে উত্তরপ্রদেশ কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে গিয়েছিল। ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টিতেই জিতেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। তার মধ্যে বিজেপি একাই ৭১টিতে। সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৫টি এবং কংগ্রেস ২টি আসনে জিতেছিল। আর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর দল খাতাই খুলতে পারেনি! ২০১৯-এ অবশ্য বিজেপিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল অখিলেশ যাদব এবং মায়াবতীর জোট। উত্তরপ্রদেশের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শত্রুতার প্রাচীর ভেঙে ‘বুয়া-বাবুয়া’ রূপে অবতীর্ণ হয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ১৫টি আসন। এসপি-বিএসপির জোট অবশ্য তার কয়েক মাস পরেই ভেঙে গিয়েছিল।
২০১৯-এর ভোটে উত্তরপ্রদেশে একা লড়ে ধরাশায়ী হয়েছিল কংগ্রেস। ৬ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিল একমাত্র রায়বরেলীতে। সোনিয়া গান্ধীর আসনে। কিন্তু নিজেদের গড় অমেঠিতে বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। এবার সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই সমঝোতা করেছিলেন অখিলেশ। ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে প্রার্থী দিয়ে ১৭টি ছেড়েছিলেন রাহুল-মল্লিকার্জুন খাড়গের দলকে। অবশিষ্ট আসনটি (পূর্ব উত্তরপ্রদেশের ভদোহী) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূলকে। সেখানে ঘাসফুল শিবির প্রার্থী করেছিল প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর পৌত্র ললিতেশপতিকে। কিন্তু ৪৪ হাজার ভোটে হেরেছেন তিনি।
জোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে ছিল না বিজেপিও। এনডিএ-র পুরনো শরিক অনগ্রসর কুর্মি জনগোষ্ঠীর দল ‘আপনা দল (এস)’-এর পাশাপাশি জাতপাতের অঙ্ক মেনে মোদী-শাহেরা টেনে এনেছিলেন আরও কয়েকটি দলকে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ নেতা জয়ন্ত চৌধরির আরএলডি, পূর্ব উত্তরপ্রদেশে মৎস্যজীবী ও মাঝি-মাল্লা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা নিষাদ পার্টি এবং রাজভড় জনগোষ্ঠীর নেতা ওমপ্রকাশ রাজভড়ের ‘সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি’ (এসবিএসপি) ছিল এই তালিকায়। বিজেপি ৭৫, এসবিএসপি ১ এবং বাকি দু’টি দল ২টি করে আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।
উত্তরপ্রদেশের চিরাচরিত জাতপাতের অঙ্কের পাশাপাশি ভোটের প্রচারে এবার মোদী জমানায় বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প, জাতগণনা এমনকি, যোগীর বুলডোজার নীতি এবং জেল হেফাজতে বাহুবলী সংখ্যালঘু নেতা আতিক আহমেদ, মুখতার আনসারির মৃত্যুকেও নিশানা করেছিল বিরোধী শিবির। এসপির যাদব-মুসলিম সমীকরণের পাশাপাশি জোট নিশানা করেছিল বিজেপির ঝুলিতে চলে যাওয়া অ-যাদব অনগ্রসর (ওবিসি) এবং অ-জাটভ দলিতদের। ৪০০ আসন নিয়ে মোদী ক্ষমতায় ফিরলে ওবিসি-দলিতদের সংরক্ষণে হাত পড়বে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন অখিলেশরা। অভিযোগ করেছিলেন, মায়াবতীর দল বিজেপির ‘বি টিম’-এর ভূমিকা নিয়েছে। আর এতেই শেষ পর্যন্ত কার্যসিদ্ধি হল অখিলেশ-রাহুলদের।
