গত ১৬ মার্চ অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। আর তারপর থেকে গত ছিয়াত্তর দিনে ২০৬টি জনসভা করে ধর্মীয় মেরুকরণ করেছেন। অবশেষে পঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে প্রচারকাজে ইতি টেনেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর তারপরই ২০১৪, ২০১৯ সালের মতোই ফের একবার অজস্র ক্যামেরার মুখোমুখি ‘নিভৃতবাসে’ তিনি। এবারে তাঁর তপস্যাস্থল তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের ধ্যানমণ্ডপ। কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানকে বেছে নেওয়ার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গুপ্ত উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা অন্তত তাই অনুমান করছেন।
কন্যাকুমারী হল দেশকে ঘিরে রাখা তিন সাগরের সঙ্গমস্থল। ফলে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের মিলনভূমি বলাও চলে। যেখান থেকে ভারত জোড়ো যাত্রার সূচনা করেছিলেন কংগ্রস নেতা রাহুল গান্ধী। বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙালির গর্ব ও অহঙ্কার। সারনাথে যেমন বুদ্ধদেব তপস্যা করেছিলেন, তেমন এই স্থানেই সমগ্র ভারতের মুক্তি ও দিশার পথ খুঁজেছিলেন বিবেকানন্দ। আবার, ১৮৯২ সালে আরএসএসের পথপ্রদর্শক একনাথ রানাডে এখানে তিনদিন ধ্যান করেছিলেন এবং স্বামী বিবেকানন্দ শিলাসৌধ বলে একে প্রচার করেছিলেন। ফলে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালকেই বেছে নেওয়া হল কারণ এটা আরএসএসেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে লোকসভা প্রচার শেষে মোদী গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রতাপগড়ে। সেখানে মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তারও একটা তাৎপর্য ছিল। আরএসএসের সদর দফতর হল মহারাষ্ট্রের নাগপুরে এবং প্রতাপগড় থেকে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। দ্বিতীয়ত, শিবাজি মহারাজ হলেন জাতীয় বীর যিনি মুসলিম আগ্রাসনের হাত থেকে মারাঠা জাতি ও দেশকে রক্ষা করেছিলেন। ১৬৫৯ সালে বিজাপুরে সুলতাল আদিলশাহের সেনাপতি আফজল খানকে যুদ্ধে পরাজিত করে রক্ষা করেন মারাঠা সাম্রাজ্যকে। এই জয়কে শিবাজি স্বয়ং হিন্দাভি স্বরাজ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালে আবার কেদারনাথের এক গুহায় ধ্যানে বসেছিলেন মোদী। কেদারনাথ হল সেই হিন্দু তীর্থ যেখানে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে বলে বিশ্বাস। সেখানে ক্যামেরায় তোলা ছবি মোদী নিজে পোস্ট করার পর দেশময় নাড়াচাড়া পড়ে যায়। সেইভাবে এবারও প্রচার শেষ এবং সপ্তম দফার ভোটের ঠিক মুখে যখন নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী মৌনসময় কাটাতে হয়, তখন মোদীর এই মৌনী সন্ন্যাসব্রতকে বিরোধীরা প্রচার কৌশল বলেই সুর চড়িয়েছে। মোদীর ছবি প্রচার করা চলবে না বলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের নালিশ জমা পড়লেও তাঁর ধ্যানের ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।
শুধু এই ধ্যান নয়, মোদীর একাধিক কর্মসূচিতেই হিন্দু ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি-রেওয়াজ সাক্ষী আছে। পুরোটাই অবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কৌশল। যেমন কুম্ভমেলায় কালো পোশাক পরে গঙ্গাস্নান। পাঁচ মেথর শ্রেণির কর্মীর পা ধুইয়ে দেওয়া। অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের আগে ১১ দিনে ৬ মন্দির দর্শন। সেগুলি হল, মহারাষ্ট্রের কলারাম মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশের বীরভদ্র মন্দির, কেরালার গুরুভায়ুর এবং থিরিপ্রায়ার শ্রী রামস্বামী মন্দির এবং তামিলনাড়ুর রঙ্গনাথস্বামী মন্দির। আবার, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি গুজরাতের দ্বারকায় সমুদ্রতলে ধ্যান করেছিলেন। এই ছবিও নিজের এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সেইভাবেই কন্যাকুমারীতে ধ্যানের উদ্দেশ্য হল আরএসএসের হিন্দুত্ব এবং ভারতকে হিন্দুবাদী করার অলক্ষ্য কৌশল।