প্রকল্পের ৪০ শতাংশ টাকা দেয় রাজ্য সরকারই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি সম্বলিত চিঠি বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে কেন্দ্র প্রচার চালাচ্ছে সব কাজ তারাই করছে। মোদী সরকারের এমন নিন্দনীয় রাজনীতির প্রতিবাদেই এবার ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই প্রকল্পে রাজ্যের অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করে নিয়ে কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আয়ুষ্মান ভারত থেকে উইথড্র করে নিলাম। অর্থাৎ তোমার থেকে তুমি টাকা দেবে। আমি দেব না। তুমি চিঠি দিয়ে বলবে তুমি করেছো। আমি কেন টাকা দেব?’
বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরে সরকারি প্রকল্পের জনসভায় ভাষণ দিতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। উপচে পড়া ভিড় তখন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের মাঠে। মঞ্চ থেকেই বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করেন তিনি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তাদের মধ্যে পরিষেবা বণ্টন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস, রত্না ঘোষ, নদীয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি রিক্তা কুণ্ডু, রাজ্যের খাদি পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা তেহট্টের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্ত-সহ অনেকেই।
গতকাল সভামঞ্চ থেকেই নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সরকারি অনুষ্ঠানে এভাবে কারও বিরুদ্ধে কিছু বলি না। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি। মোদী সরকার রাজ্যে রাজ্যে সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছে। ওই প্রকল্পে ৪০ শতাংশ অর্থ আমরা খরচ করি। অথচ রাজ্যকে কিছু না জানিয়েই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি একটা করে ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর কার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাতে প্রধানমন্ত্রীর ছবির সঙ্গে লোগোটা দেখেছেন? পদ্মফুলের মতো। সরকারি খরচে দলের প্রচার!’
এরপরই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘এই প্রকল্পে রাজ্য সরকারও টাকা দেয়। এই বছরেই ৬২৫ কোটি টাকা দিয়েছি আমরা। আর প্রচার হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর! এই রাজনীতিকে ধিক্কার জানাই। এই প্রকল্প থেকে রাজ্য সরকার নিজেদের প্রত্যাহার করে নিল।’ এখানেই না থেমে দৃশ্যত অসন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী তখন ফের ‘অগ্নিকন্যা’র মুডে। তাঁর কথায়, ‘ওঁরাও নির্বাচিত, আমরাও মানুষের ভোটে জিতে এসেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমান্তরাল প্রশাসন চালানো হচ্ছে রাজ্যে। সমান্তরাল প্রশাসন চলছে সর্বত্র, এমনকি ইনস্টিটিউশনগুলিতেও।’
এরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘উনি নাকি স্বাস্থ্য, ঘর, সব করে দিচ্ছেন। তাহলে তো রাজ্যের দরকার নেই। আপনি কি প্যারালাল স্টেট গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সব ব্যবস্থা করব আমরা। আর আপনি কী করবেন নরেন্দ্র মোদী, শুধুই দালালি? এত জঘন্য, নগণ্য সরকার দেখিনি।’ তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘গায়ের জোর, লুট আর ভাঁওতাবাজি! চেঙ্গিস খান, হিটলার আর মুসোলিনির চেয়েও ভয়ঙ্কর! আমার কাছে ডকুমেন্ট আছে। লোগো দেখেছি। সাফ বলছি, আগুন নিয়ে খেলবেন না।’ দিদির এমন আক্রমণের ধার দেখে ভিড়ে উপচে পড়া সভাস্থল সিংহগর্জন আর করতালিতে ভরিয়ে দেয় তাঁকে।
প্রসঙ্গত, এর আগে শস্য বিমা যোজনা নিয়েও একইভাবে কেন্দ্রের একতরফা প্রচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই যোজনায় বিমার প্রিমিয়ামে রাজ্য সরকারই ৮০ শতাংশ টাকা দেয়। কিন্তু সেই বিষয়টিকে আড়াল করে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কৃষকদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে যোজনাকে স্রেফ কেন্দ্রের বলে চালানো হচ্ছিল বলে অভিযোগ। বিষয়টি নজরে আসতেই ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ৮০ ভাগ দিতে পারলে, বাকি ২০ শতাংশও পারব। এটা রাজ্য শস্য বিমা যোজনা।
গতকাল মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে কৃষ্ণনগরের মাঠে ভিড় জমিয়েছিলেন প্রত্যন্ত এলাকার হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষও। তিনি তাঁদের জানান, গরিব মানুষের সামাজিক সুরক্ষায় তার থেকে সামান্য টাকা দেয় কেন্দ্র। ফলে সব প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ বহন করতে হয় রাজ্যে তৃণমূল সরকারকে। কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তোমরা রাজ্যকে তার প্রাপ্য টাকা দিচ্ছ না, আর এখান থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছ ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফেরত দিচ্ছ কত? মাত্র কয়েক শতাংশ। তাও তো আয়কর, সেস আর কাস্টমস ট্যাক্স বাবদ আদায় করা অর্থের কিছুই দাও না। এবার তাহলে আমরাও বলি, আয়কর, সেস আর কাস্টমস ট্যাক্সের ভাগও চাই।’
তাঁর অভিযোগ, ‘কেন্দ্রীয় সরকার মাছের তেলে মাছ ভাজছে। এই রাজ্যের টাকা আয়কর, বিক্রয়কর, শুল্ক ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে আর সেই টাকায় তারা নিজেদের নামে নানা প্রকল্প চালাচ্ছে।’ রাজ্যবাসীকে সতর্ক করতে তিনি বলেন, ‘তফসিলি জাতি, আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণি, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চলছে। প্রতারণা করা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে। ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন মোদী। মিথ্যা প্রলোভনে পা দেবেন না। সারা বছর শিক্ষা আর খাবার আমরাই দেব। ভাঁওতায় কান দেবেন না।’ তবে আশার কথা শুনিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেন, ‘নতুন সরকার এলে আমরা চাইব, নতুনভাবে কাজ করতে।’