একদিকে ‘অমৃতকাল’-এর ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঢাকঢোল পিটিয়ে ৭৫ তম স্বাধীনতাবর্ষ উদযাপনের ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র। অন্যদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১ তম স্থানে নেমে গেল ভারত। ২০২২-এ ভারত ছিল ১০৭ নম্বর স্থানে। এবার আরও চার ধাপ নেমে গেল। ভারতের আগে রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৬০), নেপাল (৬৯), বাংলাদেশ (৮১) এমনকী পাকিস্তানও (১০২)। শিশুদের অপুষ্টির হারও এদেশে ১৮.৭ শতাংশ, পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই দুই বিপরীত ঘটনা নিয়ে মোদী সরকারকে তীব্র আক্রমণ করলেন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে দেশ। আর আপনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন’। সোমবার দুর্গাপুরের জয় বালাজি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার সামনে শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করেছিল আইএনটিটিইউসি। উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি অভিজিৎ ঘটক প্রমুখ। এদিনের শ্রমিক সমাবেশে আগাগোড়া আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা যায় ঋতব্রতকে। মোদী সরকারের বিদেশ নীতির তুমুল সমালোচনা করেন তিনি।
ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডরের ঘোষণা আসলে মোদীর ‘হাততালি কুড়নোর চেষ্টা’ বলে কটাক্ষ করেন ঋতব্রত। জি২০ সামিটে এই করিডরের ঘোষণা করেছিলেন মোদী। ইকোনমিক করিডর ভারতের মুম্বই থেকে শুরু হবে। সেখান থেকে সংযুক্ত আমিরশাহী, সৌদি আরব, জর্ডন হয়ে ইজরায়েলে পৌঁছবে। ইজরায়েল থেকে তা গ্রিস অর্থাৎ ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হবে। ঋতব্রতর প্রশ্ন, ‘সমুদ্রের কোন অংশ ব্যবহার করা হবে, কোথায় রেল করিডর তৈরি হবে, এর জায়গা কে ঠিক করবে? এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কোথায়? এই প্রকল্পের টাকা কে যোগাবে? আমেরিকা তো হাত তুলে দিয়েছে। তাহলে কার টাকায় হবে’?
তাছাড়া সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ পণ্য পরিবহণ হয়। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের প্রাণভোমরা এই ক্যানেল। ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডর নির্মাণ হলে সুয়েজ ক্যানেলের পরিণতি কী হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও এই নিয়ে সন্দিহান। তার ওপর শুরু হয়েছে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গোটা মধ্য প্রাচ্যই সংকটে। এই পরিস্থিতিতে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডর বিশ বাঁও জলে চলে গেল বলেও মনে করছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা বিআরআই-এর পাল্টা হিসেবেই এই করিডরের ঘোষণা করা হয়। ঋতব্রতর কথায়, ‘চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা বিআরআই প্রোজেক্টে ভারতের প্রায় সব প্রতিবেশী দেশই সামিল হয়ে গিয়েছে। এই মাসেই চীনে বিআরআই নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রায় ১০০টি দেশ যোগদান করছে। বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা-সহ ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত প্রতিবেশী দেশ তাতে অংশ নেবে’। তাঁর প্রশ্ন, ‘কেন এঁরা চিনের বৃত্তে ঢুকে যাচ্ছে। ভারতের প্রভাব কমছে কেন? কেন প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতকে ভরসা করতে পারছে না’? এই ঘটনা মোদীর আমলে ভারতের বিদেশনীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে বলে মনে করেন ঋতব্রত। প্রসঙ্গত, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্টে এখনও পর্যন্ত এক হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে চিন। নেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ হাজার প্রোজেক্ট।
বাংলাদেশে আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ রফতানি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ঋতব্রত। বাংলাদেশে অভিযোগ উঠেছে, বাজারদরের থেকে অনেক বেশি দাম চাইছে আদানি। এই নিয়ে সরগরম পড়শি দেশের রাজনীতি। শুধু তাই নয়, আদানির থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারত সরকারই বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছিল বলে জানা গেছে। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রকে তীব্র আক্রমণ করেন ঋতব্রত। তাঁর প্রশ্ন, ‘কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হল’? এরপর কটাক্ষের সুরে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে মোদীর ‘কল্যাণে’ আদানি সাম্রাজের বিস্তার’।
তবে শুধু বাংলাদেশে নয়। ভারতেও একই জিনিস হচ্ছে। তাইওয়ান, দুবাই ও সিঙ্গাপুরের অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে আদানি অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করেছে। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার কয়লা। কিন্তু সেই কয়লার দাম দ্বিগুণ করে দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ কয়লার দাম যদি টন প্রতি ১০ হাজার টাকা হয়, তা ২০ হাজার টাকা করে দেখানো হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্সিয়াল টাইমসে’র প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে এই তথ্য। সমাবেশে সেই প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে শোনান ঋতব্রত। তারপর বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করেছে আদানি শিল্প গোষ্ঠী। সেই জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। ফলে কয়লার জন্য বেশি টাকা দিতে হচ্ছে আমাদের’।