অভূতপূর্ব নজির গড়ল কলকাতার এনআরএস হাসপাতাল। তাদের হেমাটোলজি বিভাগের কীর্তিতে নতুন চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন দিশার খোঁজ পেল বাংলা। পাঁচতলায় দশফুট বাই দশফুটের একটি ঘরে সূচনা হল এক গৌরবময় অধ্যায়ের। বাংলায় প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে দুরারোগ্য ক্যানসার-আক্রান্তকে ফেরানো হল জীবনের লড়াইয়ে। রোগিণী বেলা সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছিল বিভিন্ন হাসপাতাল। যুক্তি দেখিয়েছিল, ব্লাড ক্যানসারের এই কেস নিরাময় অসম্ভব। শেষ ভরসা এনআরএস। একবার দেখাই যাক না, এমনটা ভেবে হেমাটোলজি বিভাগ ভরতি করে নিল। দিনকয়েক বাদে সেই ‘দশফুট বাই দশফুট’ ঘরে জায়গা হল বেলা সরকারের। এসি আছে, কিন্তু লোহার পাতের দরজা টেনে খুলতে হয়। স্টিলের খাটে তোষক পাতা। ঘরে দূষণমুক্ত করার আধুনিক প্রযুক্তি তখন দূর অস্ত। অস্থিমজ্জা বদলের পরে বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণু রোগীর পক্ষে কতটা ঝুঁকির, সেই সহজ বিজ্ঞান স্বাস্থ্যকর্মীদের বোঝানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এরপর বেলার শরীর থেকে একটি সুস্থ অস্থিমজ্জা তুলে নেওয়া হল। কদিন বাদে বাকি সব অস্থিমজ্জা নষ্ট করা হল। আদি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হল। দিন-রাত এক করে রোগিণীর কাছে সর্বক্ষণ থাকতেন ডাঃ তুফান দলুই। মাসখানেক বাদে পরীক্ষার ফল হাতে এল। বেলার পরিবার যতটা না খুশি, তার শতগুণ আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে। ক্যানসারমুক্ত হয়েছেন বেলা! মাঝের ১১ বছরে বদলেছে অনেককিছুই। গত সপ্তাহে ২৮ বছরের রাজেশ্বর পালের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে তাঁকে ক্যানসারমুক্ত করেছে সরকারি হাসপাতাল এনআরএস, যেখানে দু’টাকার টিকিট কেটে নিখরচায় চিকিৎসা মেলে। একই সঙ্গে সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে সেঞ্চুরির লক্ষ্যমাত্রাও ছুঁয়ে ফেলেছে এনআরএস।
এপ্রসঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ ডা.পীতবরণ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘গর্ব হচ্ছে। দিল্লীর এইমস বা পিজিআই চণ্ডীগড়ে আন্তর্জাতিক মানের পরিকাঠামো। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একশোজনকে ক্যানসারমুক্ত করেছে আমাদের হাসপাতাল।’’ একই বক্তব্য উপাধ্যক্ষ ডা.ইন্দ্রাণী পালের। হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশনের বিভাগীয় প্রধান তুফান দলুইয়ের কথায়, ‘‘আমার সহযোগী চিকিৎসক নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থেকে সাফাইকর্মী, সবার সহযোগিতা না থাকলে এটা সম্ভব হত না। যাঁরা ক্যানসার মুক্ত হয়েছেন তাঁরা মাঝেমধ্যে চেকআাপে আসেন। ভাল লাগে।’’ সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। সমস্ত তথ্য পাঠানো হয়েছিল আইসিএমআরকে। বস্তুত, স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরে আর পিছন ফিরে তাকায়নি এনআরএসের হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের আর্থিক সহযোগিতায় আনা হয়েছে হেপাফিল্টার। ঘরে ঢুকলেই জীবাণুমুক্ত হবে। স্বয়ংক্রিয় সেন্সর। বিএমটি-র ঘরের সামনে দাঁড়ালেই দরজা খুলে যায়। চারটি পৃথক শয্যা। সেগুলির মধ্যেও অদৃশ্য ব্যারিকেড। রাজেশ্বর বাড়ি ফেরার দু’দিনের মাথায় আরও দু’জন বাড়ি ফিরেছেন। তুফানবাবুর সহযোগী ডা. অধ্যাপক রাজীব দে জানান, একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়, এমন দৃশ্য দেখেই ক্লান্তি ভুলে যান তাঁরা। এখন হ্যাপলেয়ড, অ্যানালোগাস (ভাই-বোন অথবা বাবা-মায়ের সুস্থ অস্থিমজ্জা) নিয়েও রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন। আবার অন্যের থেকেও (অটোলোগাস) করা হচ্ছে। এখনও অবধি সুস্থ হয়েছেন ১০৩ জন রোগী।
