১৬৬৬ দিন! অর্থাৎ প্রায় সাড়ে বছর। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে কলকাতা ডার্বিতে জয়ের স্বাদ পেল লাল-হলুদ শিবির। শনিবার ডুরান্ড কাপে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে নন্দকুমারের একমাত্র গোলে মোহনবাগানকে হারিয়ে দিল তারা। বিশ্বকাপার জেসন কামিংস-সহ পূর্ণশক্তির দল নামিয়েও ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারল না সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ২০১৯-এর ২৭শে জানুয়ারির পর আবার কলকাতা ডার্বিতে জিতল ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগান দলে সবচেয়ে আলোচিত নাম কাতার বিশ্বকাপে খেলা অস্ট্রেলিয়ার জেসন কামিংস। বলা হয়েছিল, প্রয়োজনে তাঁকে নামানো হবে। সেই দরকার এসে গেল ম্যাচের ৫৫ মিনিটেই। এ ছাড়া, ভারতীয় ফুটবল দলে মিডফিল্ডে যাঁরা নিয়মিত খেলেন, সেই সাহাল আব্দুল সামাদ, অনিরুদ্ধ থাপা, লিস্টন কোলাসোও অনেক ক্ষণ ধরে খেললেন। লিস্টনকে গোটা ম্যাচে নিয়ন্ত্রণে রাখলেন খাবরা। ক্রেসপো মাথা তুলতে দিলেন না অনিরুদ্ধকে। আর কামিংসের খেলা দেখে বোঝা গেল, এখনও ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে তাঁর। অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল দলটাই তৈরি হয়েছে কিছু দিন আগে। সেরা ফুটবলার ক্লেটন সিলভা শনিবার সকালেই এসেছেন। তাঁর খেলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। বাকি যাঁদের নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ভাল ভাবে বোঝাপড়াই গড়ে ওঠেনি। সেই দল নিয়েই বাজিমাত কর নতুন কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত। বাংলাদেশ সেনার বিরুদ্ধে যে দল আগের ম্যাচে দু’গোলে এগিয়ে ড্র করেছিল, তারাই এদিন ৬০ মিনিটে গোল দিয়ে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত আটকে রাখল ভারতের অন্যতম সেরা দলকে।
এদিন ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণ জারি রেখেছিল মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল খেলছিল খানিক রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতেই। গত তিন বছরে যে ভাবে বার বার লাল-হলুদের রক্ষণ ভেঙে ঢুকে যেতেন মোহনবাগানের ফুটবলারেরা, এ দিন সেটা হচ্ছিল না। বরং ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স ছিল অনেক ছন্দোবদ্ধ। মন্দার রাও দেশাই ইতিমধ্যেই ভারতীয় ফুটবলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বাঁ দিক থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনিই। অভিজ্ঞ হরমনজ্যোত খাবরাও ছিলেন দুর্ভেদ্য। মন্দ খেলেননি জর্ডান এলসেও। ম্যাচের প্রথম গোলের সুযোগটা পেয়েছিল মোহনবাগানই। বাঁ প্রান্ত থেকে উঠে এসেছিলেন লিস্টন কোলাসো। তিনি পাস করেছিলেন আর্মান্দো সাদিকুকে। চলতি বলে সাদিকুর শট বারের বেশ কিছুটা উপর দিয়ে চলে যায়। এর পর ধীরে ধীরে ম্যাচে ফেরে ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের আক্রমণের পাল্টা দিয়ে প্রতি আক্রমণে উঠতে থাকে তারা। বক্সের একটু বাইরে ডান দিকে একটি ফ্রিকিক পায় ইস্টবেঙ্গল। লম্বা ক্রস পেয়েছিলেন জর্ডান এলসে। কিন্তু হেডে সঠিক পাস দিতে পারেননি। মোহনবাগানের গোলকিপার বিশাল কাইথ বল তালুবন্দি করেন। কিছু ক্ষণ পরে আবার সুযোগ এসেছিল ইস্টবেঙ্গলের সামনে। এ বার বাঁ প্রান্ত ধরে উঠে আসা মহেশ পাস দেন জেভিয়ার সিভেরিয়োকে। স্পেনের খেলোয়াড়ের শট আটকে দেন মোহনবাগানের ডিফেন্ডার আনোয়ার। তার পরেই সিভেরিয়ো পাস দিয়েছিলেন নন্দকুমারকে। কিন্তু একটু জোরে পাস হওয়ায় মোহন গোলকিপার বিশাল এগিয়ে এসে সে যাত্রা দলকে বাঁচিয়ে দেন। মোহনবাগানও থেমে থাকেনি। সেই সময়ে ইস্টবেঙ্গল টানা আক্রমণ করলেও প্রতি আক্রমণে একটি সুযোগ পেয়েছিল সবুজ-মেরুন। বাঁ দিক থেকে আশিস রাই বল বাড়িয়েছিলেন মনবীরের উদ্দেশে। কিন্তু মনবীরের শট অনেক উপর দিয়ে উড়ে যায়। এরপর ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দুই দলই নেমেছিল গোলের লক্ষ্যে। কিন্তু ফাইনাল থার্ডে গিয়ে মোহনবাগান সুযোগ কাজে লাগাতে পারছিল না। হুগো বুমোস মাঝ মাঠ সে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। লিস্টনকে কার্যত পকেটে পুরে রেখেছিলেন খাবরা। ফলে মনবীরও বল পাচ্ছিলেন না। গোলের লক্ষ্যে ৫৫ মিনিটের মাথায় জোড়া বদল আনেন মোহনবাগানের কোচ জুয়ান ফেরান্দো। একসঙ্গে নামিয়ে দেন দুই বিদেশিকে। বুমোস এবং সাদিকুকে তুলে নামান অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপার জেসন কামিংস এবং দিমিত্রি পেত্রাতোসকে। কাকতালীয় হলেও তার পরেই গোল খেয়ে যায় মোহনবাগান। আনোয়ার আলির ভুল পাসে বল পেয়েছিলেন সাউল ক্রেসপো। তিনি পাস দেন ডান দিকে থাকা নন্দকুমারকে। সামনে তখন মোহনবাগানের মাত্র দু’জন খেলোয়াড়। নন্দকুমার বেশ খানিকটা এগিয়ে কিছুটা থমকালেন। মোহনবাগানের ডিফেন্ডারকে মাটি ধরিয়ে বাঁ পায়ের বাঁকানো শটে বিশালকে পরাস্ত করে জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি।
নন্দের গোলের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তাল হয়ে ওঠে লাল-হলুদ গ্যালারি। চার বছর পর যুবভারতীতে ডার্বিতে গোল করল ইস্টবেঙ্গল। দীর্ঘ দিন বাদে পাওয়া মুহূর্ত খোয়াতে চাইছিলেন না ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা। উল্টো দিকে থাকা মোহনবাগান গ্যালারিতে তখন স্তব্ধতা। গোল করে কিছুটা সময়ের জন্যে তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে উঠেছিল মোহনবাগান। কামিংস অন্তত দু’টি ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথম বার তাঁর ডান পায়ের শট আটকে যায় ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারের গায়ে। দ্বিতীয় বারের সুযোগটা অনেক ভাল। বাঁ দিকে ভাসানো ক্রস। কিন্তু কামিংসের বাঁ পায়ের শট উড়ে গেল বারের উপর দিয়ে। ম্যাচ শেষের তখন মিনিট কয়েক বাকি। যুবভারতী জুড়ে নামল বৃষ্টি। তার মধ্যেই একটানা আক্রমণ করে গেল মোহনবাগান। তবুও মিলল না গোল। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে প্রদক্ষিণ করলেন লাল-হলুদ শিবিরের ফুটবলারেরা। বাঁধভাঙা আনন্দে পিল পিল করে মাঠে ঢুকে পড়লেন সমর্থকেরা। যুবভারতীতে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গ্যালারিতে একের পর এক বাজি ফাটতে শুরু করেছে। বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় সেনাবাহিনীর কর্তারা সমর্থকদের তাড়া করা শুরু করলেন। কিন্তু আবেগ কি আর বারণ মানে? রীতিমতো হিমশিম খেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। রাতটাই তো ছিল লাল-হলুদের। ম্যাচের অনেকক্ষণ পরেও দর্শকাসনে ‘ইস্টবেঙ্গল, ইস্টবেঙ্গল’ করে চেঁচিয়ে গেলেন সর্মথককুল। রাতের মেঘেই ফাঁক দিয়েই যেন উঁকি দিল নতুন সূর্য, নতুন ভোর, নতুন সংকল্পের হাতছানি।