পর পর দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবারও অনগ্রসর শ্রেণি বা ‘পিছলে-বর্গ’ থেকে প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি। আগেরবার রামনাথ কোবিন্দ আর এবার দ্রৌপদী মুর্মু। অন্যদিকে, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর (জগদীপ ধনকর) আইনজ্ঞ সত্ত্বার বাইরে তাঁর কৃষক পরিবারের সদস্য সত্ত্বাকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করেছে তারা। কিন্তু এঁরা সরাসরি গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এঁদের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আনা হয়নি বা প্রধানমন্ত্রী পদে বা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঠাঁই হয়নি।
আবার, মহারাষ্ট্রের একনাথ শিন্ডে (যিনি প্রাথমিক ভাবে ছিলেন অটো-চালক এবং পরে শিবসেনার মাধ্যামে ক্ষমতার অলিন্দে এসেছেন) শিবসেনার মধ্যে বিভাজন তৈরি করে নতুন নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কিন্তু তিনিও শিখন্ডি হিসেবে থাকলেন। আসল নিয়ন্ত্রকের জায়গায় থাকলেন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। আসলে এটাই বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতির নতুন খেলা। পিছলে-বর্গকে আলঙ্কারিক পদে বসিয়ে গণমাধ্যমের পর্দায় বিশাল রাজনৈতিক অবয়ব তৈরি করতে নিয়ে আসা। আর আসল ক্ষমতার পদে এলিট-বর্গের লোকজনকে বসানো।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতে জাতীয় কংগ্রেস বেশ অনেকটা সময়কাল ধরে (১৯৪৭-৭৭) নিজেদের ওপর দায়িত্ব স্বআরোপিত করে নেয় পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টিকে একটি নির্দষ্ট পথে (পরিকল্পিত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত) উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার। ১৯৭৭ থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে পিছলে-বর্গের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় বিত্তশালী কৃষকদের (বুলক কার্ট ক্যাপিটালিস্ট)। এবং ১৯৮৯ সালের মণ্ডল-কুমণ্ডল সংরক্ষণের রাজনীতি ও ১৯৯২ সালে বারবি মসজিদ কাণ্ডের পর থেকে পিছলে-বর্গের অস্তিত্ব নির্বাচনী ভোট-ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমার্থক হয়ে ওঠে।
কখনও সংরক্ষণ, কখনও ধর্মীয় মেরুকরণ আবার কখনও জোট রাজনীতির জন্য। নয়ের দশকে কংগ্রেস ঘরানার সরকারের আমলে কেআর নারায়াণান রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ‘পিছলে-বর্গ’ থেকেই। আসলে নয়ের দশকে ভারতীয় রাজনীতি ‘পিছলে-বর্গ’কে সম্মান ও সম্ভ্রম প্রদান করতে থাকে নির্বাচনী আঁতাতের মাধ্যমে বা বিভিন্ন জনকল্যাণকারী প্রকল্পের মাধ্যমে বা আলঙ্কারিক পদ প্রদানের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে মীরা কুমারের লোকসভা অধ্যক্ষের পদে আসীন হওয়া সেই খেলারই এক দৃষ্টান্ত।
এরপর ২০১৪ সালে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে কেন্দ্রে। ২০১৯ সালে তারা আবারও তারা ক্ষমতায় আসে আরও বেশি জনাদেশ নিয়ে। তারা কংগ্রেস মুক্ত ভারত বা কংগ্রেসের সমস্ত ব্যবহারিক ও নীতিগত পথ বর্জন করে নতুন ভারত বা আত্মনির্ভর ভারতের পথ অনুসন্ধান করতে উদ্যত হয়। কিন্তু পিছলে-বর্গের অবস্থান কোথাও যেন এক হয়েই থাকে। রামনাথ কোবিন্দ বা দ্রৌপদী মুর্মুদের ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র আলঙ্কারিক পদেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ ভারতবর্ষে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির পদের মতোই আলঙ্কারিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদের মতো ক্ষমতায় বলিয়ান পদ নয়।
আসলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে কোনো বদল আসেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে সেই ‘এলিট-বর্গ’ আছে। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক সি রাইট মিলস ১৯৫৬ সালে ‘সামরিক-শিল্পপ্রতিষ্ঠান’ এলিট তত্বের অবতারণা করেছিলেন। আজ ২০২৩-এর ভারতে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্পোরেট-রাজনীতিবিদ এলিট-বর্গ, যেখানে রাজনীতিবিদ মানেই এলিট নয়। সেই রাজনীতিবিদ এলিট যাঁর কর্পোরেট উপস্থিতি আছে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা, মোহন ভাগবত, দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, নিদেনপক্ষে বাবা রামদেবও এলিট-বর্গ। কিন্তু রামনাথ কোবিন্দ বা দ্রৌপদী মুর্মুদের ভারতীয় রাজনীতির দাবা খেলায় ঘুঁটি হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।