শুক্রবার উড়িষ্যার বালেশ্বরে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। যার ফলে গোটা এলাকা কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। প্রসঙ্গত, বরাবরই এই ট্রেন আর পাঁচটা দূরপাল্লার ট্রেনের চেয়ে সামান্য আলাদা। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে উজ্জ্বল মুখ প্রায় চোখে পড়ে না এই ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে। চোখে পড়ে না বাড়ি ফেরার স্বস্তিও। বরং দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনাই লেপ্টে থাকে ভিড়ে। যাত্রীদের মধ্যে কেউ হুইলচেয়ারে চেপে ট্রেনে ওঠেন, তো কেউ হাতে স্যালাইনের বোতল লাগানো অবস্থায়। কারণ, করমণ্ডল এক্সপ্রেসে করে মূলত দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশেই যান বহু মানুষ।
ট্রেনটি যেহেতু হাওড়ার শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই এ রাজ্যের মানুষ। মূলত ভেলোরে এবং তা ছাড়াও চেন্নাই অ্যাপোলো-সহ দক্ষিণ ভারতের একাধিক বড় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান তাঁরা। থাকেন প্রচুর শিশু ও বয়স্ক মানুষও। রোগীদের ট্রেন শুধু নয়, সাধারণ গরিব মানুষেরও বড় ভরসা এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস। কলকাতা থেকে চেন্নাই স্লিপার ক্লাসের ভাড়া ৬৩০ টাকা, থ্রি-এসি ১৬৭০ টাকা। ১৬৫৯ কিলোমিটার দূরত্বের তুলনায় সস্তাই বলা চলে। ২৭ ঘণ্টা যাত্রাপথের শেষে যেন আরোগ্য নিকেতনে পৌঁছন যাত্রীরা। তাই বড় এক ভরসার নাম এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস!
শুধু সাধারণ রোগী ও রোগী পরিবার নয়, বাংলা থেকে দক্ষিণে কাজ করতে যাওয়া বহু পরিযায়ী শ্রমিকেরও ভরসা এই ট্রেনই। দুপুরবেলা পেট ভরে ভাত খেয়ে ওঠেন তাঁরা চিঁড়েমুড়ি বেঁধে, রাতটা ট্রেনে কাটিয়ে, পরের দিন বিকেলে পৌঁছে যাওয়া গন্তব্যে। শুক্রবার বিকেলেও এই একই উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, ভরসা– সব কিছু সঙ্গে নিয়েই দীর্ঘ হুইসল বাজিয়ে ট্রেন ছেড়েছিল শালিমার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। বিদায়ী পরিজনরা হাত নেড়েছিলেন ট্রেনের জানলায়, কেউ বা দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, সুস্থ হয়ে ফিরুক ঘরের মানুষটা। তখনও কেউ জানতেন না, কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে শুরু করা এই মঙ্গলযাত্রা আসলে কতটা অভিশপ্ত।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্রথম স্টেশন খড়্গপুর পার হওয়ার পরে সন্ধে ছ’টা নাগাদ বালেশ্বর পেরোয় ট্রেন। এর কিছু পরেই পৌনে সাতটা নাগাদ বিকট এক শব্দ। সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেল, তার পরেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ট্রেনের ১৮টি কামরা বেলাইন! ইঞ্জিনের পর থেকে স্লিপার ক্লাস, প্যান্ট্রি কার-সহ একাধিক বগি দুমড়েমুচড়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত ২৯৫ জন ট্রেনযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। আহত অন্তত ৬৫০। তা আরও বাড়তে পারে বলেই অনুমান। বেশিরভাগ যাত্রীই চিকিৎসার উদ্দেশেই চলেছিলেন চেন্নাই। অনেকে আবার শ্রমিকের কাজ করতে। প্রচুর বয়স্ক ও শিশুর লাশ ইতিমধ্যেই উদ্ধার হয়েছে, এখনও ট্রেনের ভিতরে দলা পাকিয়ে আটকে আছে বহু দেহ।