গতকাল উড়িষ্যার বালেশ্বরের কাছে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবল পড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। আর তারপরেই প্রশ্ন উঠে গেছে, করমণ্ডলে কি ‘কবচ’ প্রযুক্তি ছিল? না-থাকলে কেন তা এমন একটি জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনে ব্যবহার করা হয়নি? ব্যবহার করা হলেও কি তা দুর্ঘটনা রোধ করতে পারত?
প্রসঙ্গত, অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সিস্টেমে নকশা-করা একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা পদ্ধতির পোশাকি নাম ‘কবচ’। পরিভাষায় বলা হয় ‘অটোমেটেড ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম’। দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘রিসার্চ ডিজ়াইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন’-এর মাধ্যমে তৈরি এই সেন্সরভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ট্রেনের ব্রেকিং সিস্টেম কাজ না-করলে বা চালক জরুরি পরিস্থিতিতে ট্রেন থামাতে ব্যর্থ হলেও সংশ্লিষ্ট ট্রেনটি নিজে থেকেই থেমে যাবে। এর ফলে যে কোনও ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাবে ট্রেনটি।
শুধু বিপদের সময় পরিত্রাণ দেওয়াই নয়, বলা হয়েছিল, এই ব্যবস্থায় বিপদ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য আগেই ট্রেনের চালক পেয়ে যাবেন। ‘আপডেট মেশিন ইন্টারফেস’ মাধ্যমে লোকো পাইলট সতর্ক থাকতে পারবেন। এখানেই শেষ নয়। কোনও ট্রেন অতিরিক্ত গতিতে দৌড়োলেও স্বয়ংক্রিয় ব্রেকের মাধ্যমে ট্রেনটির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দু’টি ইঞ্জিনের মধ্যে সংঘর্ষ রোখা যাবে। এই পদ্ধতির আর একটি সুবিধা হল, নেটওয়ার্ক পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচলের গতিবিধির ওপর সরাসরি নজর রাখা যাবে।
দুই বা ততোধিক ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ রোধ করতে ‘কবচ’ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব দাবি করেছিলেন, এই প্রযুক্তি বা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ১০ হাজার বছরে মাত্র এক বার দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে! কিন্তু তা শুধু দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ রোধ করে, না একই লাইনে একটি ট্রেনের পিছনে অন্য একটি ট্রেন গিয়ে ধাক্কা মারলে তা-ও রুখতে পারে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। আবার একইসঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘কবচ’ পদ্ধতি তখনই কাজ করবে, যখন সংশ্লিষ্ট দু’টি ট্রেনেই ওই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। একটি ট্রেনে থাকলে সংঘর্ষ রোখার ক্ষমতা ওই প্রযুক্তির নেই।
আবার, যাত্রিবাহী ট্রেন ছাড়া মালবাহী ট্রেনে ‘কবচ’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, এমন কোনও পরিকল্পনাও এখনও রেলের নেই। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে একই লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা একটি মালগাড়ির পিছনে ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হয়েছে। তা-ই এক্ষেত্রে ‘কবচ’ প্রযুক্তি কাজ করার কথাও ছিল না। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পরে মালগাড়িতেও ‘কবচ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজনীয় কি না, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৩ জানুয়ারি জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির দোমহনিতে দুর্ঘটনায় পড়ে আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয় মোট ৮টি কামরা। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ৯ যাত্রীর। ময়নাগুড়িতে গিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত শুরু হয়েছিল। তখনই শুরু হয়েছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ‘কবচ’-এর মাধ্যমে ওই ধরনের দুর্ঘটনা রুখে দেওয়ার চিন্তাভাবনা। তার কয়েক মাস পরেই ভারতীয় রেল জানিয়ে দেয় ‘প্রযুক্তি তৈরি’। দেশের ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে পর্যায়ক্রমে ওই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।
কিন্তু শুক্রবার উড়িষ্যার বালেশ্বরের কাছে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ‘কবচ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে! ওই ব্যবস্থা কি দক্ষিণ-পূর্ব রেলে কার্যকর করা গিয়েছে? গেলেও সেই কাজের গতিপ্রকৃতি এখন কেমন? ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ১,৪৪৫টি রুটে ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে ‘কবচ’ কার্যকর হয়েছে।
৫ মাস আগে রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এখন দিল্লি-মুম্বই এবং দিল্লি-হাওড়া করিডরে (৩,০০০ কিলোমিটার) কাজ চলছে।’ কেন পর্যায়ক্রমে ওই কাজ হচ্ছে? জবাবে রেলমন্ত্রী জানান, এমন অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কার্যকর করার মতো সব রেলপথ যুতসই নয়। তাই আগে রেলপথের আধুনিকীকরণ করতে হচ্ছে। তার পরে সংঘর্ষরোধী অত্যাধুনিক ‘সিস্টেম’ কার্যকর করা যাবে। সে জন্যই ধাপে ধাপে কাজ চলছে। সেই কাজ এখন কতটা এগিয়েছে, তা অবশ্য অজানা।